তারপর? রবিন জানতে চাইল।
সাপটা দেখল। ওটার গলায় ঝোলানো কার্ড পড়ল, টেবিল থেকে তুলে বাড়িয়ে ধরল জিনা। এই যে, এটা।
সাদা কার্ডটা দেখাল কিশোর। জোরে জোরে পড়ল: বিলিয়াল তার পাওনা চায়। হীরার চেয়ে মানুষের জীবন অনেক বেশি আকর্ষণীয় তার কাছে।
দেখেছ, জিনা বলল, বড় বড় হরফে পরিষ্কার করে লিখেছে! পাঠকের মনে ছাপ ফেলবার জন্যে!
সফল হয়েছে নিশ্চয়? জিনার দিকে তাকাল রবিন।
হয়েছে। টলে উঠেই পড়ে গেল খালা। আগে কাউকে বেহুশ হতে দেখিনি! ভয়ই পেয়ে গেলাম। খানিক পরেই গোঙাতে শুরু করল খালা, চোখ মেলল। ধরে ধরে অনেক কষ্টে তাকে ওপরে নিয়ে গেছি।
পুলিশকে বলতে রাজি হয়েছে?
না। অনেক বার বলেছি, বুঝিয়েছি, শুনতেই রাজি না। বলেছি, সাপটা আছে, কার্ডটা আছে, পুলিশকে প্রমাণ দেখাতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু শুনলই না আমার কথা। খালি বলে, জিহাভোকে নেকলেস দেয়া ছাড়া নাকি আর কোন উপায় নেই।
তার মানে নেকলেসটা দিতে যাচ্ছেন? কিশোর বলল।
না। ওটা পেয়ে গেছি, আমার কাছে।
চুপ করে রইল তিন গোয়েন্দা।
কয়েকদিন আগে টেলিভিশনে একটা সিনেমা দেখেছিলাম, খুলে বলল জিনা। স্পাই ছবি। মেয়েদের বাথরুমে টুরানো সাবানের বাক্সে একটা মাইক্রোফিল্ম লুকিয়ে রাখল গুপ্তচর। খালাও দেখেছে ছবিটা। নিজের বুদ্ধিতে কিছুই করতে পারে না খালা, ভাবতেই বুঝে গেলাম। নেকলেস কোথায় লুকিয়েছে। তোমরা যাওয়ার পর গিয়ে খুঁজলাম। হ্যাঁ, যা ভেবেছি তাই।
তুমি নিশ্চয় আরও ভাল জায়গায় লুকিয়েছ, মুসা বলল।
তোমাদেরকে জানিয়ে রাখি, রসিকতার সুরে বলল জিনা, যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তো গ্যারাজে খুঁজো। ঘোড়ার ওট বিনের টিনে।
মন্দ না, মাথা নাড়ল মুসা।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, খালার অবস্থা ভাল না। বিছানায় পড়ে আছে, দেয়ালের দিকে চোখ। মনে হলো, অসুখ করবে।
অসুখ খুব খারাপ হতে পারে, সাবধান করল কিশোর। এমনিতেই দুর্বল, না?
আগে ভালই ছিল। মিস পলের অ্যাকসিডেন্টের পর থেকেই কাহিল হয়ে পড়েছে।
তাকে এখন একা থাকতে দেয়া ঠিক নয়। দাঁড়াও, চাচীকে আসতে ফোন করছি।
জিনার মুখ উজ্জ্বল হলো। খুব ভাল হবে। তোমার চাচী খুব শক্ত মনের মহিলা! তাকে সব কথা বলব। হয়তো খালাকে পুলিশের কাছে মুখ খুলতে রাজি করাতে পারবেন।
শুধু শক্ত বললে ভুল হবে, কিশোর শুধরে দিল। চাচীর স্নায়ু ইস্পাতে তৈরি। কিন্তু, এই অবস্থায় চাচীও কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। তোমার খালা ভ্যারাড আর বিলিয়ালের ভয়ে কাতর, এখন অন্য কিছু ভাবতেই চাইবেন না। চাচীকে শুধু বলব, তোমার খালার অবস্থা খারাপ, তুমি একা সামলাতে পারছ না।
তা-ও ঠিক।
উঠে গিয়ে বাড়িতে ফোন করল কিশোর।
ঠিক পনেরো মিনিটের মাথায় হাজির হয়ে গেলেন মেরি চাচী। মিস মারভেলের ঘরে ঢুকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলেন ঘরের আর মহিলার অবস্থা। গভীর ভ্রূকুটি করলেন জিনা আর ছেলেদের দিকে তাকিয়ে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, এক্ষুণি ঘুমাতে যাওয়া উচিত জিনার, ছেলেদের বাড়ি ফেরা উচিত।
কিশোরের দিকে তাকালেন মেরি চাচী। তুই আর তোর চাচা বাইরে খেয়ে নিস রাতে, আমি থাকছি। সকালে ফোন করব। বলেই রান্নাঘরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি। খুটখাট আওয়াজ শুনেই বোঝা গেল, রেফ্রিজারেটর আর তাকগুলো খোঁজাখুঁজি করছেন।
জিনা, আজ রাতে পেট ভরে খেতে পারবে, হেসে বলল কিশোর। খবরদার, একবারও বলবে না, ওটা আরেকটু দিন। চাচী যদি মনে করে তোমার পেট ভরেনি, বুঝবে ঠেলা।
আমার যেতে ইচ্ছে করছে না, বার বার রান্নাঘরের দিকে তাকাচ্ছে মুসা। আজ রাতে আমরাও এখানেই থেকে যাই না কেন? কত কী। লাগতে পারে রাতে, তখন কাকে ডাকবেন চাচী?
পারলে চাচীকে গিয়ে বলো সে-কথা, হাসল কিশোর, জিনার দিকে ফিরল। আসলে আর থাকার দরকারই নেই আমাদের। ওসব গান গাওয়া সাপ-টাপের পরোয়া-মেরি চাচী করবে না; আর হ্যাঁ, তোমার খালা সাহস পাচ্ছেন না, কিন্তু তুমি তো জানাতে পারো পুলিশকে? বলবে, ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে তোমার খালাকে।
না না, বাপু, আমি পারব না, জোরে জোরে মাথা নাড়ল জিনা। খালাকে ভূতে ধরেছে, একথা গিয়ে পুলিশকে বলতে পারব না। খালাও পরে শুনলে খুব দুঃখ পাবে।
ঝটকা দিয়ে রান্নাঘরের দরজা খুলে গেল। কিশোর! মেরি চাচীর তীক্ষ্ণ কষ্ট, এখনও দাঁড়িয়ে বকবক করছিস কেন তোরা? মেয়েটাকে ঘুমোতে দিবি না নাকি?
তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এল ছেলেরা।
সন্ধ্যার পরে ফোন করল কিশোর। ধরলেন মেরি চাচী। কড়া গলায় জানালেন, জিনা ঘুমোচ্ছে, মিস মারভেল ঘুমায়নি, তবে শান্তই রয়েছে। বিছানায় না গিয়ে এত রাত অবধি কী করছে কিশোর, কৈফিয়ত চাইলেন। শেষে ধমক দিয়ে বললেন, সকালের আগে যেন আর কোন ফোন না করে।
চিত হয়ে শুয়ে ছাতের দিকে চেয়ে রইল কিশোর, ভাবছে। ঘুমিয়ে পড়ল এক সময়, দুঃস্বপ্ন দেখল: অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে পোড়ো বাড়িতে কালো মোম জ্বলছে। বীভৎস সব ছায়ারা নেচে বেড়াচ্ছে আলোর আশপাশে। কাক-ভোরের আগে নীরব এক মুহূর্তে ঘুম ভাঙল তার, ঘামছে দরদর করে। মনে পড়ল সাপের মূর্তিটার কথা, আতঙ্কে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া মিস মারভেলের কথা।
মনের পর্দায় ভেসে উঠল ডক্টর জিহাভোর কালো পোশাক পরা মূর্তি, ভীষণ ফেকাসে চেহারা। দুদিন আগেও এত তাড়াহুড়ো ছিল না লোকটার। এখন এতই অস্থির হয়ে উঠেছে, পারকারদের বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করছে মিস মারভেলকে হুমকি দিতে। কেন?