বারান্দার ছাতকে ঠেকিয়ে রেখেছে যেন বড় বড় থাম, সেদিকে চেয়ে বলল মুসা, মেরি চাচী তার দাদীর স্কার্টটা পরে এলে মানাত এখানে।
হাসল কিশোর। কোন্ আমলের বাড়ি এটা!
মধ্যযুগের হলেও অবাক হব না! রবিন বলল। কিন্তু ঘোড়াশালটা কোথায়?
বাড়ির পেছনের সীমানা দেখাল মুসা। ওই যে একটা মাঠ, কাঁটাতারে ঘেরা।
চলো, ওখানেই নিয়ে যাই, প্রস্তাব দিল কিশোর।
প্রাসাদের এক পাশে পাথরে বাঁধানো চতুর প্রায় ঢেকে গেছে। ওইসটেরিয়া লতাঝাড়ে। তার এক পাশে কংক্রিটের সরু পথ ধরে পেছনের মাঠে ঘোড়াটাকে নিয়ে চলল তিন গোয়েন্দা।
বাড়ির পেছনে বিশাল আঙিনা। তার পরে তারে ঘেরা মাঠ, মাঠের পরে পাশাপাশি তিনটে গ্যারাজ। একটা গ্যারাজের মস্ত দরজা হাঁ হয়ে খোলা, ভেতরে ঘোড়া বাঁধার জায়গা দেখা যাচ্ছে। দেয়ালে গাঁথা বড় বড় পেরেকে ঝুলছে দড়ি।
বাড়ির পেছনের দরজা খুলে উঁকি দিল রুজ। এই যে, ছেলেরা, কমেটকে নিয়ে এসেছ? মাঠে ছেড়ে দিয়ে ভেতরে এসো। মিস মারভেল তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান।
আবার দরজা বন্ধ করে দিল রুজ।
ঘোড়াটার দিকে চেয়ে আপন মনেই বলল মুসা, কমেট!
হ্যাঁ, বাংলায় বলে ধূমকেতু, বলল কিশোর। চাচীকে রুজ বলেছে, ঘোড়াটাকে নাকি শুধু মেট বলে ডাকে জিনা।
তার মানে বাংলায় কেতু?
আরে, না, হেসে উঠল কিশোর। মেটের বাংলা, বন্ধু।
এই মিস মারভেলটা কে, জানো? জিজ্ঞেস করল রবিন।
জিনার খালা। এখানেই থাকবে, কিশোর জানাল। রুজ বলে, এই খালাটা নাকি অদ্ভুত!
অদ্ভুত?
জানি না কেন বলে, মহিলার আচার-আচরণ নাকি ভাল লাগে না রুজের। আমরা তো যাচ্ছিই, দেখব, কেন ভাল লাগেনি।
ঘোড়ার জিন আর লাগাম খুলে নিল কিশোর। রবিন গেট খুলে দিতেই মাঠে ঢুকে পড়ল কমেট।
গ্যারাজে জিন রাখার জায়গায় জিন রাখল কিশোর, লাগাম ঝুলিয়ে রাখল একটা পেরেকে। তারপর প্রাসাদের পেছনের একটা দরজা খুলে দুই সঙ্গীকে নিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। রান্নাঘর। জানালা দিয়ে এসে পড়া রোদের আলোয় ঝলমল করছে মস্ত ঘরটা।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল ওরা চওড়া বিরাট এক হলঘরে। বায়ে খাবার ঘর। হলের ছাতে ঝুলছে, সেই বহুল আলোচিত ঝাড়বাতি। ওপাশের জানালা দিয়ে চোখে পড়ে ওইসটেরিয়া ঝাড়ে ঢাকা চতুর। ডানে একটা শোবার ঘর, খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে হালকা সবুজ দেয়াল, ওপরের দিকে সোনালি রঙের কারুকাজ। শোবার ঘরের পাশে আরেকটা দরজা, ওই দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আরেকটা ঘর, দেয়াল আলমারির তাকে তাকে ঠাসাঠাসি করে রাখা বই।
হলঘরের সোফায় আধশোয়া হয়ে আছে জিনা, আহত হাঁটুর নিচে একটা তোয়ালে। ওর পাশে বসে আছে এক বয়স্কা মহিলা। পরনে নীলচে-লাল মখমলের গলাবন্ধ লম্বা গাউন, গলায় রূপার একটা চেপ্টা আঙটা। লালচে-ধূসর চুল। বাতাসে ল্যাবিণ্ডারের গন্ধ, পুরানো গির্জার শব-রাখা ঘরের কথা মনে করিয়ে দেয়।
খালা, সোফায় রক্ত লাগালে মা মেরে ফেলবে আমাকে, জিনা বলল। আমি ওপরতলায়…।
চুপ করে বসো এখানে, শান্ত কণ্ঠে বলল মিস মারভেল। এতবড় একটা আঘাত। ছেলেদের দিকে একবারও তাকাল না মহিলা। কাঁচি দিয়ে জিনার প্যান্ট হাঁটুর কাছ থেকে কেটে নামিয়ে দিল। ইসস, অনেকখানি কেটেছে!
ও কিছু না, অভয় দিলেন মেরি চাচী। ফায়ারপ্লেসের কাছে একটা চেয়ারে বসেছেন। ওষুধ লাগালেই সেরে যাবে।
মাকড়সার জাল দরকার, আনমনে বলল মিস মারভেল।
মাকড়সার জাল! মেরি চাচীর ভুরু কুঁচকে গেছে।
মাকড়সার জাল! চমকে উঠল জিনার কাছে দাঁড়ানো রুজ, হাতের গরম পানির পাত্র থেকে ছলকে পড়ল পানি।
নড়েচড়ে উঠল সহকারী, দুই গোয়েন্দা, অস্বস্তি বোধ করছে। গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে তাকাল মুসা, চোখে জিজ্ঞাসা।
হেসে রুজকে বলল কিশোর, খুব অবাক হয়েছেন মনে হচ্ছে? মাকড়সার জাল নেই নাকি এ-বাড়িতে?
রেগে উঠল রুজ। জাল কী করে থাকবে? এক কণা ধুলো রাখি না আমি, ঝেটিয়ে দূর করি, আর জাল থাকবে! লাল হয়ে গেছে তার মুখ।
হায় রে কপাল! আক্ষেপ করল মিস মারভেল। সাধারণ মাকড়সার জাল, তা-ও মেলে না এখানে! কী আর করা। যাও, আমার ওষুধের বাক্স থেকে সোনার ছোট বয়মটা নিয়ে এসো।
রুজ চলে গেল। ছেলেদের দিকে মুখ তুলে তাকাল মিস মারভেল, জিনাকে সাহায্য করার জন্যে ধন্যবাদ দিল। তারপর বলল, আমার কথা
তো শোনে না। কতবার বলেছি, আর কিছু না হোক, গলায় অন্তত লাল একটা রুমাল বেঁধে নাও, সব রকম অঘটন থেকে রেহাই পাবে। লাল রঙ দুর্ঘটনা ঠেকায়, জানো তো?
নিশ্চয়ই, জবাব দিল কিশোর।
ছোট একটা সোনার বয়ম এনে মিস মারভেলের হাতে তুলে দিল রুজ।
এতেও চলবে, বলল জিনার খালা। মাকড়সার জালের মত তত কাজের নয়, তবে ভাল। আমি নিজে বানিয়েছি। ছিপি খুলে মলম বের করে বোনঝির আহত জায়গায় ডলে লাগিয়ে দিল।
মেডিক্যাল অ্যাসোশিয়েশনের অনুমোদন আছে? জানতে চাইল জিনা।
কী যে বলো না তুমি, মেয়ে, অনুমোদন দিয়ে কী হবে? কাজ হলেই হলো, বলল মিস মারভেল। অমাবস্যার রাতে নিজে শেকড়-পাতা জোগাড় করেছি আমি। ওই দেখো, লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে রক্ত বন্ধ হয়ে। গেছে।
অনেক আগেই রক্ত বন্ধ হয়েছে আমার, ওই আজেবাজে জিনিস না লাগালেও চলত, খালা। এবার কী? হুইলচেয়ার আনতে বলবে?
একটা ব্যাণ্ডেজ হলে, তাতে মাছির ডিম ভেঙে মাখিয়ে… খালার কথা শেষ হওয়ার আগেই উঠে দাঁড়াল জিনা। লাগিয়ে পচে মরি। ওসব কিছু লাগবে না আমার! সিঁড়ির দিকে রওনা হলো সে। ছেলেদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় থামল, থ্যাঙ্কস! শুনলাম, মেটকে জায়গামতই এনে রেখেছ।