গেটের কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। চাঁদের আলো বিচিত্র আলো আঁধারি সৃষ্টি করেছে আইভি লতার ঝাড়ে, এরই কোন একটা ফাঁকে রয়েছে খোপ, তাতে সুইচ। অনুমানে একটা ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে দিল সে, পয়লা বারেই হাত লাগাল সুইচে। সুইচ মানে প্রাস্টিকের একটা লিভার। চাপ দিতে গিয়েও থেমে গেল। ঘণ্টা বেজে উঠবে না তো? কিন্তু উঠলেও কিছু করার নেই। কাঁপা হাতে চাপ দিল। ঘণ্টা বাজল না, আলো জ্বলল না। গুঞ্জন তুলে খুলতে শুরু করল পাল্লা। ঠিক এই সময় দপ করে জ্বলে উঠল ফ্লাডলাইট।
এই! এই, ছেলে! দাঁড়াও! চিৎকার শোনা গেল দোতলা থেকে।
ফিরেও তাকাল না, কিশোর, গলা শুনেই বুঝতে পেরেছে, রড। গেটের দিকে লাফ দিল সে।
দাঁড়াও! আবার ধমকে উঠল রড।
দাঁড়াল না কিশোর, এক লাফে গেট পেরিয়ে এল। গায়ের ওপর এসে পড়ল ভারি একটা শরীর, তাকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ল রাস্তায়। ভ্রামম। করে বিকট শব্দ হলো, মাথার ওপর দিয়ে শা করে উড়ে গেল কিছু।
ওঠার চেষ্টা করল কিশোর।
কানের কাছে ধমক দিল কেউ, চুপ! নোড়ো না!
আবার গর্জে উঠল শটগান, শাঁ শাঁ করে উঠে গেল ছররা, প্রায় কান ঘেঁষে।
কিশোরকে চেপে ধরে রেখেছে লোকটা। দ্বিতীয় গুলি হওয়ার পরই ছেড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, দৌড় দাও!
লাফিয়ে উঠে মাথা নিচু করে করবীর ঝোঁপের দিকে ছুটল লোকটা। কিশোরও দৌড় দিল তার পেছনে। ঝোঁপ পেরিয়ে ঘুরে এসে রাস্তায় পড়ল দুজনে।
থেমো না! কিশোরকে হুশিয়ার করেই মোড় নিয়ে আরেক দিকে ছুটল লোকটা।
থামল না কিশোয়। পা কাঁপছে, বুকের ভিতর যে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে।
সানসেট অ্যাণ্ড টরেনটি রোডের মোড়ে অপেক্ষা করছে পিকআপ। কিশোরকে দেখেই জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দিল বোরিস। হোকে (ওকে)?
কোন মতে মাথা ঝোকাল কিশোর। পিকআপের পিছনে তাকে টেনে তুলল মুসা আর রবিন। গাড়ি ছেড়ে দিল বোরিস।
কী হয়েছে? জিনা জিজ্ঞেস করল।
চুপ করে বসে জিরিয়ে নিল কিশোর। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল গোঁফওয়ালা।
ফোর্ড?
হ্যাঁ। ওকে ধন্যবাদ জানানোরও সময় পাইনি।
কেন?
ফোর্ড না থাকলে ঝাঁজরা হয়ে পড়ে থাকতাম এখন। মাথা ঠিক রাখতে পারেনি রড। ব্যাটার একটা ডবল ব্যারেল শটগান আছে, গুলি করে বসেছিল।
ষোলো
ডাইনীবিদ্যা, ঘোষণা করল রবিন।
হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা। লাইব্রেরি থেকে কয়েকটা মোটা বই নিয়ে এসেছে রবিন। তার একটা: উইচক্র্যাফট, ফোক মেডিসিন অ্যাণ্ড ম্যাজিক। বইটাতে টোকা দিল সে। হয়তো এটা থেকেই তথ্য জোগাড় করেছে ওরা, অন্য কোন বইও হতে পারে অবশ্য। সেটা কথা না; কথা হলো, ওরা ডাইনীবিদ্যা নিয়ে চর্চা করছে। একেক দেশে এর একেক নাম। ইংরেজরা বলে ব্ল্যাক ম্যাজিক, ওয়েস্ট ইণ্ডিজের লোকেরা বলে ভুডু, ইণ্ডিয়ানরা বলে প্রেতসাধনা কিংবা কালিসাধনা। যে যা-ই বলুক, সোজা কথা, শয়তানের পুজো করে ওরা, কালো পথে ক্ষমতার অধিকারী হতে চায়। আমাদের টরেনটি ক্যানিয়নের জনাবরাও এই কাজই করছে, কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারছে বলে মনে হয় না।
বলির পাঁঠারা বিশ্বাস করছে না বলে? কিশোর বলল।
হ্যাঁ, বিশ্বাস করছে না বলে, সায় দিল রবিন।
তোমাদের কথা কিছু বুঝছি না আমি, অনুযোগ করল মুসা। দয়া করে খুলে বলবে?
খুব সহজ, উইচক্র্যাফটের ওপর লেখা বইটা তুলে দেখাল রবিন। এতে সব লেখা আছে। রুকসটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নরবিজ্ঞানের প্রফেসর ডক্টর জন এ, স্মিথের লেখা। ব্ল্যাক ম্যাজিক নিয়ে গবেষণা করার জন্যে অনেক দেশে ঘুরেছেন তিনি; আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, মেকসিকো, অস্ট্রেলিয়া, কোথাও বাদ রাখেননি। ওঝাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন। তিনি দেখেছেন, যারা ভুডুর চর্চা করে, তারা কাউকে মারতে চাইলে ওই লোকের নাম করে একটা পুতুলের গায়ে পিন বিধিয়ে দেয়। তারা বলে, পুতুলের যেখানে পিন বেঁধানো হলো, মানুষটাও ঠিক ওখানেই ব্যথা পাবে। পুতুলের বুকে পিন বেঁধাল, মানুষটারও বুকে বিধবে, ফলে মারা যাবে সে। মেকসিকোতে প্রেতপূজারিরা গিয়ে ঢোকে কোন অন্ধকার গুহায়, মোম জ্বেলে মন্ত্র পড়ে। তারপর একটা বিশেষ সুতো কেটে দুটুকরো করে ফেলে। তার মানে, কোন একজন মানুষের আয়ু কমিয়ে দিল। লোকটা যখন জানতে পারে, তার নাম করে সুতো কেটেছে ওঝা, সে অসুস্থ হয়ে পড়ে, তারপর মরে যায়।
বুঝলাম না, মুসা বলল।
মানে, মানুষটা ওঝার কথায় বিশ্বাস করে, বুঝিয়ে দিল কিশোর, ভয় পেয়ে যায়। ফলে অসুস্থ হয়ে মারা পড়ে সে।
শুধু বিশ্বাসে এত মারাত্মক কাণ্ড ঘটে? ফেকাসে হয়ে গেছে মুসার চেহারা।
আন্তরিকভাবে যদি কোন কথা বিশ্বাস করো, সেটা ঘটতে বাধ্য, আবার বইটাতে টোকা দিল রবিন। প্রফেসর ব্যারিস্টার তাই বলেছেন। তিনি দেখেছেন, ওঝা ঘোষণা করার পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে মানুষটা, মারা গেছে কয়েক দিন পর। প্রফেসরের ধারণা: মন্ত্র-ফন্ত্র সব বাজে কথা! তীব্র আতঙ্কই কাহিল করে করে মেরে ফেলেছে লোকটাকে।
হুমম! বুঝলাম! মাথা দোলাল মুসা। ভ্যারাড আর জিহাভোও একই কাণ্ড করছে! ব্যাটারা পুতুল কিংবা সুতো বাদ দিয়ে সাপ ব্যবহার করছে। যার ক্ষতি করতে চায়, তার কাছে জাদুর সাপ পাঠাচ্ছে!
হ্যাঁ, কিশোর বলল। কিন্তু জাদুর জ-ও জানে না ব্যাটারা। তা ছাড়া যাদের কাছে পাঠাচ্ছে, তারাও বিশ্বাস করছে না, ভয়ও পাচ্ছে না। মিস অ্যানি পল বিশ্বাস করেনি। তার কাছে ওটা স্রেফ একটা সস্তা অদ্ভুত ব্রেসলেট। জিনার খালাই শুধু বিশ্বাস করে কেঁদেকেটে মরছে, তার ধারণা, সাপই বুঝি অ্যাকসিডেন্টটা ঘটাল। ফলে নিজেকে দোষ দিচ্ছে। খুব স্বাভাবিক। তার মত মহিলা এই-ই তো করবে।