পড়ল। বাইরে পায়ের আওয়াজ, ঘরে ঢুকল, দরজা বন্ধ হলো জোরে।
কটা ছেলে, বলল একটা কণ্ঠ, কৌতূহলী হয়ে উঠেছে।
ওদের কৌতূহল মিটিয়ে দেয়া উচিত ছিল তোমার, রড, কালো আলখেল্লা পরা লোকটার গলা। যাতে কোন সন্দেহ না থাকে ওদের মনে। সব কটা বেরিয়ে গেছে তো?
হ্যাঁ।
কাপড়ের আড়ালে থেকে হাসি পেল কিশোরের। গেছে, তবে সবাই নয়, মিয়া, শয়তানের চেলা-মনে মনে বলল সে, একজন রয়ে গেছে। সে এখন খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে, কী নিয়ে কী কারণে শয়তানী শুরু করেছ তোমরা!
পনেরো
ছোট্ট একটা ফুটো দেখতে পেল কিশোর কালো কাপড়ে, ওটাতে আঙুল ঢুকিয়ে অতি সাবধানে ছিঁড়ে বড় করতে শুরু করল। ফুটোটা বড় হতেই তাতে চোখ রেখে দেখল, দরজার কাছে একটা সুইচে আঙুল রাখছে। গার্ড। রড়। ক্লিক করে একটা শব্দ হলো, মাথার ওপরে জ্বলে উঠল উজ্জ্বল আলো।
শঙ্কিত হলো কিশোর। মোমের আলোয় কাটেনি ঘরের অন্ধকার, যেখানে যেখানে আলো পড়েছিল, সেখানেও ছিল ছায়ার নাচন, ফলে তার লুকিয়ে থাকা চোখে পড়েনি কারও। কিন্তু এখন? উজ্জ্বল আলোয় চোখে। পড়ে যাবে না ওদের? গোল টেবিলে ধুলো দেখতে পাচ্ছে এখন সে পরিষ্কার দেয়াল ঢাকা দেয়ার কাপড় পুরানো, মলিন, একেবারেই বাজে, কমদামী জিনিস। রূপার মোমদানীগুলো আরও পুরানো, ঘষেমেজে চকচকে করা হয়েছে।
ঘর আর আসবাবপত্রের চেয়ে শোচনীয় লোক দুটোর অবস্থা। ধূসর চুলওয়ালা গার্ড ফুঁ দিয়ে দিয়ে নেভাচ্ছে মোমগুলো। মুখের চামড়ায় গভীর ভজ, চোখের কোণ থেকে শুরু করে ঠোঁটের কোণে এসে শেষ হয়েছে। মেদ জমেছে শরীরে, চলাফেরা ভারি, থুতনির নিচটা ঝুলে পড়েছে।
সিংহাসনে বসে আস্তে আস্তে সাপের মাথায় টোকা দিচ্ছে কালো আলখেল্লাধারী, চিন্তিত। চেয়ার পেছনে ঠেলে পা তুলে দিল টেবিলে। উজ্জ্বল আলোয় তার চেহারা আর তেমন রক্তশূন্য লাগছে না। আলগা রঙ, বুঝল কিশোর। সাদাটে-সবুজ কোন পাউডার মেখেছে মুখের ভাজ আর নাকের দুপাশে।
টেলিফোন সিসটেম একেবারে ফেল মারল!হঠাৎ বলল লোকটা।
শেষ মোমটা নিভিয়ে, গিয়ে একটা চেয়ারে বসল রড। দেখো, আমি গিয়ে গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম, কে আসছে কে যাচ্ছে, ভাল মত খেয়াল রাখতে পারতাম। কিন্তু তাতেও কিছু হত না। বাচ্চাদেরকে ঠেকানো শয়তানের অসাধ্য, আর আমি তো মানুষ। কোন না কোনভাবে ঢুকে পড়তই ওরা। মনে হচ্ছে, তল্পি গোটানোর সময় এসে গেছে। চলো, কেটে পড়ি। স্যান ফ্রানসিসকো কিংবা স্যান ডিয়েগো কিংবা শিকাগোতে গিয়ে আবার নতুন খেল শুরু করা যাবে। অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার আগেই চলো কাটি। এখানে তোমার ডক্টর। জিহাভোগিরি আর বেশিদিন চলবে না।
কিন্তু, রড, এখনও অনেক আসা বাকি, এক টানে মাথার কালো টুপিটা খুলে ছুঁড়ে ফেলল ডক্টর জিহাভো। মাথায় আগুন-লাল চুল। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখে ঘষতে শুরু করল লোকটা। মুখের সবজে পাউডার ঝরে যেতেই বেরিয়ে পড়ল লাল চামড়া।
কষ্টে হাসি চাপল কিশোর।
এখানে না ফেললে চলত না? বিরক্ত মুখে বলল রড। ঝাড়বে কে ওগুলো?
ভাবছি, রুমালটা মুঠোয় দলা পাকাচ্ছে জিহাভো, আরও কিছু দিন দেখা দরকার। পুরো সেটআপটা ঠিক করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। গরুগুলোকে খুঁজে বের করতে কম কষ্ট করেছি? ওই নাপতিনীটা, গ্যানারিল, ওর কাছ থেকে বেশ কিছু পাওয়া গেছে, তাকে এখন বাদ দিলেও চলে। আর ওই কন্ট্রাকটার ব্যাটার কাছ থেকেও প্রচুর পাওয়া গেছে। মিস মারভেল এখনও কিছু দেয়নি, তবে দেবে শিগগিরই। এত ভাল ব্যবসা কয়েকটা বাচ্চার ভয়ে হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে পালাব?
ভাল ব্যবসাটা কতদিন ভাল থাকবে, ভাবছি!
ঠিকমত চালানো গেলে থাকবে আরও আনেক দিন, হাসল জিহাভো। শুধু জানতে হবে কীভাবে কী করা দরকার। ওই রলির কথাই ধরো। চমৎকার দেখিয়েছে। অচল করে দিল অ্যানি পলকে, কেউ কিছু সন্দেহ করতে পারল না। মিস মারভেলের ভাবগতিক দেখেছ আজকে?
ভয় পেয়েছে।
মূৰ্ছা যেতে বাকি রেখেছে। দাবি পূরণ না করলে সেটাও যাওয়াব। তবে, রাসলারকে ভয় পাওয়ানো কঠিনই হবে। ওর ব্যাপারে কিছু একটা করতেই হচ্ছে।
নাক দিয়ে ছোঁক ছোঁক শব্দ করল রড। ও-ব্যাটার কাজটা করে দিলেই তো হয়ে যায়। রাস্তার ওপারের রেস্তোরাঁর মালিককে কোনভাবে ভয় দেখিয়ে ভাগিয়ে দিলে সব কাস্টোমার আসবে রাসলারের ওখানে।
ভুল করছ। শুধু টাকাই চায় না রাসলার, ক্ষমতাও চায়। সেটা কী করে দেব তাকে?
আমি কী জানি! হাত ওল্টাল রড।
তোমাকে জানতে বলছিও না, বার বার হাতের আঙুলের মাথা এক করছে, আর সরিয়ে আনছে জিহাভো। কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। দরকার পড়লে… হাই তুলল। যাক গে, যখনকারটা তখন ভাবা যাবে। ঘুম পেয়েছে। উঠে দরজার দিকে রওনা দিল সে।
টুপি ফেলে যাচ্ছ, মনে করিয়ে দিল রড।
থাক গে, সকালে তুলে নেব, বেরিয়ে গেল জিহাভো। সিঁড়িতে মিলিয়ে গেল পায়ের শব্দ।
বিড়বিড় করে গাল দিল রড, কাকে বোঝা গেল না। চেয়ার ঠেলে উঠে দ্রজার দিকে রওনা দিল। সুইচ টিপে আলো নেভাল।
সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শুনল কিশোর, বোধহয় জিহাভোকে অনুসরণ করেছে রড। দড়াম করে দরজা বন্ধ হলো! পানির পাইপ থেকে পানি পড়তে শুরু করল বাড়ির পেছনে কোথাও
কাপড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে অনুমানে পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগোল কিশোর; যে পথে ঢুকেছিল, সে-পথ ধরে আবার ফিরে এল প্রথম হলঘরটায়। রান্নাঘরের দরজা খোলাই রয়েছে। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেটের দিকে চলল সে। ফিরে তাকাল একবার, ওপরতলায় কয়েকটা জানালায় আলো। একটা পর্দায় মানুষের ছায়া পড়েছে। হাসল কিশোর। ডক্টর জিহাভো মুখ ওপর দিকে তুলে ধরেছে, কুলকুচা করছে বোধহয়। ইস, এই মুহূর্তে যদি ওর একটা ছবি তোলা যেত!