মোম-সাদা হাত দিয়ে টুপিটা আধ ইঞ্চিমত পেছনে সরাল লোকটা, মাথা একটুখানি নুইয়ে সালাম জানাল।
একে একে যার যার চেয়ারে বসে পড়ল সদস্যরা।
দুবার হাততালি দিল আগন্তুক।
টেবিলের কাছ থেকে নিঃশব্দে যেন উড়ে চলে গেল ভ্যারাড, ফিরে এল হাতে ট্রে নিয়ে। তাতে একটা রূপার বড় কাপ, ট্রেসহ কাপটা বাড়িয়ে দিল সে সিংহাসনে বসা লোকটার দিকে।
বিলিয়াল আমাদের সহায় হোন! বলে কাপ তুলে ঠোঁটে ছোঁয়াল লোকটা।
মোলক শুনছেন সব! জবাবে সুর করে জারিগান গেয়ে উঠল যেন বারোটা কণ্ঠ।
কাপটা মিস মারভেলের হাতে তুলে দিল কালো আলখেল্লা। বিলিয়াল সবার মঙ্গল করুন! গলা কাঁপছে মিস মারভেলের, চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলবে। কাপে চুমুক দিয়ে সেটা তুলে দিল পাশের লোকের হাতে।
হাতে হাতে ঘুরতে থাকল কাপ, বিলিয়ালের জয়ধ্বনিতে ভরে উঠল। ঘর। বার বার সুর করে জারিগান গেয়ে, মোলক যে সব শুনছেন সেটা ঘোষণা করল সদস্যরা। কাপটা আবার ফিরে এল কালো আলখেল্লার হাতে, সে রেখে দিল ভ্যারাডের ট্রেতে।
এ কয়লা রাখার চার পা-ওয়ালা ছোট একটা তাওয়া নিয়ে এল ভ্যারাড, টেবিলে রাখল কালো টুপির সামনে। তাওয়ায় জ্বলন্ত কয়লা। উঠে দাঁড়িয়ে কয়লার ওপরে হাত ছড়াল লোকটা, চেঁচিয়ে বলল, অ্যাসমোডিউস, অ্যাবাড়ন, ইবলিশ, দয়া করে আমাদের দিকে তাকান!
রূপার একটা ডিশ এনে দিল ভ্যারাড। ওটা থেকে কী যেন খানিকটা নিয়ে জ্বলন্ত কয়লায় ছিটাল কালো পোশাক পরা লোকটা, প্রায় লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল ঘন ধোয়া, বাতাসে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল মিষ্টি একটা গন্ধ।
বিলিয়াল, শুনছেন! মিনতিভরা কণ্ঠ লোকটার, মহাসর্পের শক্তিকে পাঠান আমাদেরকে পাহারা দিতে! দেখা দিন দয়া করে! শোনান আপনার মিষ্টি গলা!
চুপ হয়ে গেল লোকটা। চুপ হয়ে গেল অন্যরাও। স্থির হয়ে অপেক্ষা করছে।
আস্তে আস্তে কানে এল শব্দটা, সেই বিচ্ছিরি গানের শুরু।
এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়াল জিনা, পালাবে, খপ করে তার হাত ধরে ফেলল কিশোর। ফেরাল।
বাড়ছে শব্দ। বাড়ছে, আরও বাড়ছে, মাংস চিরে ঢুকে যাচ্ছে যেন শব্দের ফলা, হাড় ভেদ করে মজ্জায় ঢুকতে চাইছে!
আবার রূপার ডিশ থেকে খানিকটা জিনিস তুলে নিয়ে কয়লায় ছিটাল লোকটা। ভক্ করে লাফিয়ে উঠল আবার ঘন ধোঁয়ার স্তম্ভ। স্তম্ভের মাথায় কী যেন নড়ছে!!
অস্ফুট একটা শব্দ বেরোল রবিনের গলা থেকে, তার টুটি টিপে ধরেছে যেন কেউ।
বিলিয়াল দয়া করেছেন আমাদের! কালো টুপির গলায় আনন্দ। অমর মহাসর্প দেখা দিয়েছেন!
মানুষগুলো যেন সব পাথর হয়ে গেছে, দৃষ্টি ধোয়ার স্তম্ভের মাথায় স্থির। মস্ত এক গোখরো সাপ দেখা যাচ্ছে, নীলচে-সবুজ রঙ, ছড়ানো ফণা, টকটকে লাল চোখ জ্বলছে!
বেড়েই চলেছে শব্দ। কানের পর্দা ফুড়ে মগজে ঢুকে যাবে যেন। আর সইতে না পেরে কানে আঙুল দিল কিশোর। হঠাৎ করেই কমতে শুরু করল তীক্ষ্ণ আওয়াজ, পাতলা হয়ে এসেছে ধোঁয়ার স্তম্ভ, মিলিয়ে যাচ্ছে সাপটা। থেমে গেল গান। মহাসৰ্প-ও গায়েব।
এ ধপ করে সিংহাসনে বসে পড়ল কালো পোশাক পরা লোকটা। মঙ্গল হোক আমাদের। আসুন, হাত মেলাই।
হাত বাড়িয়ে দিল মিস মারভেল, বোধহয় লোকটার হাতেই রাখতে চাইল, কিন্তু ভুলে পড়ল টেবিলে। হাতটা তুলে নিল লোকটা।
মুসার গায়ে কনুইয়ের খোঁচা লাগাল কিশোর। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ, পরক্ষণেই নেমে এল একটা মূর্তি, ছেলেদের দৃষ্টিপথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। পেশীবহুল লোকটাকে দেখেই চিনল মুসা, সেদিন দেয়াল থেকে সে পড়ে যাওয়ার পর ওই লোকটাই এসে ধরেছিল তাকে। গার্ড। চুপ করে দাঁড়িয়ে হলের দৃশ্য দেখল, এক মুহূর্ত দ্বিধা করে পায়ে পায়ে এগোল টেবিলের দিকে। সিংহাসনে বসা লোকটার কানে কানে কী বলল।
অসম্ভব! বলে উঠল লোকটা। আরা সবাই হাজির এখানে?
তেরোজন হওয়ার কথা, গার্ড বলল। মিস গ্যানারিল, মিস মারভেল আর মিস্টার ভ্যারাড় একসঙ্গে ঢুকেছেন। এগারোবার গেট খুলেছি আমি, তার মানে অন্তত আরও একজন এখানে থাকার কথা।
উঠে দাঁড়াল কালো টুপি। তার মানে ফাঁকি দিয়ে ঢুকেছে কেউ! বৈঠক বাতিল! সময় করে আবার ডাকব আপনাদের, এখন যার যার বাড়ি যান।
আস্তে দরজা বন্ধ করে দিল কিশোর।
ব্যাটারা টের পেয়ে গেছে! ফিসফিসিয়ে বলল মুসা।
হলরুমে চেয়ার টানাহেঁচড়ার শব্দ, কথা বলছে সবাই।
ব্যাটা সাংঘাতিক হুশিয়ার! কিশোর বলল। ঠিক সন্দেহ করে বসেছে!
চলো, পালাই! তাড়া দিল রবিন। খোঁজা শুরু করবে এখুনি?
তোমরা যাও, কিশোর বলল।
এটা মজা করার সময়?
মজা করছি না, গলা আরও খাদে নামাল কিশোর। যেদিক দিয়ে ঢুকেছ, ওদিক দিয়ে বেরোবে। বেরোনোর সময় ইচ্ছে করেই শব্দ করবে। তারপর দেয়ালে চড়ে বসে দেবে অ্যালার্ম বাজিয়ে। ওদের বোঝাবে, ফাঁকি দিয়ে যে ঢুকেছিল, সে পালিয়েছে। ট্রাক নিয়ে চলে যাবে। সানসেট অ্যাণ্ড টরেনটিতে তোমাদের সঙ্গে দেখা করব। ঠিক আছে?
কিশোরকে সাবধানে থাকতে অনুরোধ করে অন্য দুজনের সঙ্গে চলে গেল রবিন।
রান্নাঘরের দরজা দড়াম করে বন্ধ হলো, বাইরে গার্ডরা হৈ-চৈ করে উঠল। জিনার চিৎকার শোনা গেল হঠাৎ, তারপরই বেজে উঠল ঘণ্টা।
চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিশোর। ধীরে ধীরে থেমে এল গোলমাল, হৈ-চৈ। বাইরে নীরবতা, ঘরও নীরব। আস্তে করে আবার দরজাটা খুলে হল-এ উঁকি দিল সে। নির্জন। এক ছুটে খিলানে ঢাকা পথ পেরিয়ে হল-এ ঢুকল এসে, দেয়াল-ঢাকা একটা কালো কাপড়ের তলায় লুকিয়ে