আটজন, প্লাস, জেরি গ্যানারিল, মিস মারভেল আর ভ্যারাড, বলল কিশোর, এগারোজন। বাড়ির ভেতরে আছে আরেকজন, নিশ্চয় বাড়ির মালিক, মোট বারোজন। সেরাতেও বারোজনই ছিল। তার মানে মোট। সদস্য এই-ই!
চুপ করে রইল অন্য তিনজন।
আরও মিনিট দশেক গেল, কেউ এল না। নিশ্চিত হলো কিশোর, বারোজনই। ওঠার সিদ্ধান্ত নিল সে।
হুশিয়ার! সতর্ক করল মুসা। সেই দারোয়ান ব্যাটার হাতে পড়া চলবে না!
নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে ঘাসে ঢাকা আঙিনা ধরে এগোল ওরা। লম্বা একটা জানালায় অতি ম্লান আলো দেখা যাচ্ছে, ভারি পর্দা ভেদ করে আলো বেরোতে পারছে না ভালমত। জানালার কাছ থেকে দূরে রইল, ওরা, ঘুরে চলে এল বাড়ির পেছন দিকে।
দরজা, ফিসফিস করে বলল কিশোর। সামান্য ঝুঁকে অন্ধকারে এগোল সাবধানে, যাতে কোন কিছুতে হোঁচট খেয়ে না পড়ে। দরজার নব ধরে মোচড় দিল, নড়ল না নব; তালা লাগানো।
কিশোরের কাঁধে হাত রাখল জিনা। ওই যে, কানের কাছে বলল, সে। একটা জানালা। খোলা আছে মনে হয়। এত ওপরে, ছিটকিনি লাগানোর কথা ভাববে না ওরা।
ভাঁড়ার বোধহয়, জানালাটার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। খুব বেশি ছোট।
আমি ঢুকতে পারব, বলে উঠল জিনা।
না, তুমি পারবে না, রবিন মাথা নাড়ল। আরও সরু শরীর হতে হবে।
ঠিকই বলেছ, কিশোর বলল। তার মানে তোমাকেই যেতে হচ্ছে। আমিও ঢুকতে পারব না। পারবে?
খুব পারব।
সাবধান!
জানালার নিচে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল মুসা। তার কাঁধে উঠে দাঁড়াল রবিন।
খোলা? নিচ থেকে জিজ্ঞেস করল জিনা।
শশশ! আস্তে! কান পেতে শুনছে কিশোর, কাঠে কাঠ ঘষার শব্দ।
গুঙিয়ে উঠল রবিন, হাতে ভর দিয়ে টেনে তুলল শরীরটা, জানালা দিয়ে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কেটে গেল দীর্ঘ এক মিনিট। ক্লিক করে মৃদু একটা শব্দ হলো, আস্তে করে খুলে গেল পেছনের দরজা, একটু আগে যেটা খোলার চেষ্টা করেছিল কিশোর।
এসো, চাপা গলায় ডাকল রবিন। ওরা সামনের কোন একটা ঘরে রয়েছে।
আরেকটা ঘরে এসে ঢুকল ওরা, রান্নাঘর। সামনের দিকে ম্লান। আলো দেখা যাচ্ছে। ঘরের অন্য পাশের দরজার কাছে এসে ওপাশে উঁকি দিল কিশোর, একটা হলঘর। বাঁয়ে চওড়া সিঁড়ি, ডানে সিঁড়ির ঠিক উল্টো দিকে একটা দরজা, ওপর দিক ধনুকের মত বাঁকানো। ওই দরজা দিয়েই আসছে আলো।
আবার আগের জায়গায় ফিরে এল কিশোর। জানালায় পর্দা নেই, বাইরে গাছের মাথায় ঘোলাটে জ্যোৎস্না, আবছা আলো এসে পড়েছে। ঘরে। একটা স্টোভের আদল চোখে পড়ছে। কাছেই কোথায় জানি একটা কলের চাবি ঠিকমত লাগানো হয়নি, পানি পড়ার টুপটাপ শব্দ। কানে আসছে। বায়ে দেয়ালের গায়ে মস্ত এক কালো ফোকর, না না, আরেকটা দরজা, পাল্লা খোলা।
রবিনের কাঁধে হাত রাখল কিশোর, মাথা কেঁকাল রবিন। জিনার হাত ধরে তাকে নিয়ে তৃতীয় দরজাটার আরেক পাশে চলে এল কিশোর, তাদেরকে অনুসরণ করল অন্য দুজন।
গাঢ় অন্ধকার। দৃষ্টি পুরোপুরি অচল। অনুমানে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোল ওরা। নানারকম জিনিস হাতে ঠেকছে, পায়ে ঠেকছে। নরম একটা কিছু হাতে ঠেকল মুসার, চাপ দিয়ে বুঝল সোফা।
অবশেষে অন্ধকারে চিড় ধরল, আলোর সূক্ষ্ম একটা চুল দেখা গেল, দরজার ফাঁক দিয়ে আসছে। জিনার হাত ছেড়ে দিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর, মসৃণ পাল্লায় হাত বোলাল। হাতে নব ঠেকতেই মোচড় দিল আস্তে করে। নিঃশব্দে ঘুরে গেল নব। টেনে পাল্লাটা কয়েক ইঞ্চি ফাঁক করল সে।
চোখে পড়ল খিলানে ঢাকা আলোকিত পথ, তার ওপারে বিরাট এক হলঘর।
বৈঠক শুরু করা যায়, কানে এল ভ্যারাডের পরিচিত খসখসে কণ্ঠ।
দরজা আরও কয়েক ইঞ্চি ফাঁক করল কিশোর। অন্য তিনজনও এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। সবারই নজর হলঘরে। রূপার মোমদানীতে জ্বলছে লম্বা কালো কালো মোম। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা গোল টেবিল, কালো কাপড়ে ঢাকা। টেবিল ঘিরে বারোটা চেয়ার, প্রতিটি চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়েছে একজন করে। ভ্যারাডের সামনের চেয়ারটাকে ছোটখাট একটা সিংহাসন বলা চলে, হাতল দুটো কাঠের তৈরি দুটো কালো গোখরো, ফণা উঁচিয়ে রেখেছে। তার পাশে জিনার। খালা। বিষণ্ণ, নিষ্প্রাণ চাহনি।
সদস্যরা সব নীরব, নিথর, অথচ ঘরের সর্বত্র যেন নড়াচড়ার আভাস! কিশোরের মনে হলো, মানুষগুলোকে ঘিরে নাচছে অন্ধকারের কালো চাদর, হাসছে বিকট হাসি, নীরবে। চারদিকে শুধু কালো আর কালো। দেয়াল ঢাকা কালো কাপড়ে, দরজা-জানালায় কালো পর্দা। এ যেন কালোর রাজত্ব!
নড়েচড়ে দাঁড়াল ভ্যারাড, এক পা থেকে আরেক পায়ে শরীরের ভর বদল করছে। বৈঠক শুরু করা যায়, সেই একই কথা, একই কণ্ঠ।
খিলানে ঢাকা পথের এক পাশ থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে, তাতে পায়ের শব্দ হলো। লম্বা আলখেল্লা পরা একটা কালো মূর্তি নেমে এল, হালকা পায়ে গিয়ে দাঁড়াল টেবিলের ধারে। সাপ-সিংহাসনে বসল সে এদিকে ফিরে।
ইয়াল্লা! বিড়বিড় করল মুসা, ভীষণ চমকে গেছে।
চমকে দেয়ার মতই চেহারা আগন্তুকের। ভ্যারাডের চেহারা আর কী এমন ফেকাসে! এই লোকটাকে দেখে মনে হলো, গায়ে এক বিন্দু রক্ত নেই। কবর থেকে উঠে এসেছে যেন একটা লাশ। সারা গা কালো কাপড়ে ঢাকা, এমনকী মাথার চুলও কালো টুপি দিয়ে ঢেকে রেখেছে, সার্জনদের টুপির মত আঁটসাট টুপি। মোমের চেহারা যেন, তাতে টকটকে লাল দুটো চোখ।