নিজের চেয়ে খালার জন্যে বেশি ভাবছি আমি, জিনা বলল। আমাকে কচি খুকী ভাবে ওরা, ভাবুক, ভালই। কিন্তু খালা যে বিপদে পড়তে যাচ্ছে। আজ রাতে আবার প্রেতবৈঠক বসবে টরেনটি ক্যানিয়নের সেই বাড়িতে। ডক্টর শয়তান আজ দেখা দিতে পারে, বলল ভ্যারাড। খালা প্রথমে যেতে রাজি হয়নি, কিন্তু পরে শুনলাম যাবে।
চমৎকার! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
মোটেই চমৎকার নয়! পাল্টা চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করল জিনা। ভয়ঙ্কর এক প্রেতবৈঠকে খালাকে দেখতে চাই না আমি!
প্রেতসাধনা করছে, না কী করছে, শিওর না হয়ে কিছুই বলা যাচ্ছে। না। তোমার খালাকেও ভ্যারাডের খপ্পর থেকে ছাড়িয়ে আনার কোন উপায় দেখছি না। …আজ রাতেও আমরা যাব…
আমিও যাব, ধরে বসল জিনা।
জিনা, প্লিজ! অনুরোধ করল মুসা।
না, আমি যাবই, গোঁ ধরল জিনা। তোমাদের চেয়ে আমার দায়িত্ব বেশি, কারণ, আমার খালা! ভ্যারাড় আমার বাড়িতে থাকছে, আমাকে জ্বালাচ্ছে। তা কখন রওনা হচ্ছ?
সন্ধ্যায়, কিশোর বলল। এই সাড়ে সাতটার দিকে।
কোথায় দেখা হবে তোমাদের সঙ্গে?
এখানেই চলে এসো। দেখি, চাচীকে গিয়ে ধরতে হবে। পিকআপটা নিতে পারলে ভাল।
আমি যাই, বাক্সটা জ্যাকেটের পকেটে নিয়ে বেরিয়ে গেল জিনা।
রাজি হলে কেন? মুসা আপত্তি করল। গিয়ে বিপদে পড়লে?
ওকে দেয়ালের ওপরে উঠতে না দিলেই হলো, মুচকি হাসল। রবিন।
দেখো, এক কথা বার বার ভাল্লাগে না! রেগে গেল মুসা।
আরে, দূর, ঝগড়াঝাটি রাখো তো, হাত তুলল কিশোর। এক কাজ করো, তোমরা আজ আমাদের এখানেই খাও। সকালে দেখলাম, অনেকগুলো আনারস আনিয়েছে চাচী, মোরব্বা বানাবে, মুসার দিকে চেয়ে হাসল সে।
ঝকঝকে সাদা দাঁত বেরিয়ে পড়ল মুসার, রাগ পানি। রবিনের দিকে চেয়ে বলল, যাও, মাফ করে দিলাম।
চোদ্দ
আমিও ঢুকব, জেদ ধরল জিনা।
ঢুকবে! বিরাট গেটের দিকে চেয়ে আছে কিশোর, চিন্তিত। দেখা যাক!
করবীর ঝোপে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে চারটি ছেলেমেয়ে। নজর বাড়ির গেটের দিকে, মেহমানরা কখন আসে, সেই অপেক্ষায় আছে। পথের মোড়ে পাহাড়ের গা ঘেষে পিকআপ থামিয়ে তাতে বসে আছে বোরিস।
আমি ওটাতে চলে যাই, গেটের আরও কাছে আরেকটা করবীর ঝোঁপ দেখিয়ে বলল রবিন। কে কী বলে, শুনতে পাব।
মাথা কাত করল কিশোর।
ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক চেয়ে এক ছুটে গিয়ে অন্য ঝোঁপটায় ঢুকে পড়ল রবিন।
প্রথম গাড়িটা এল। জেরি গ্যানারিল নেমে রাস্তা পেরিয়ে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, খোপ থেকে রিসিভার নিয়ে কানে ঠেকাল। এই সময় এল নীলচে-লাল করভেট, ড্রাইভিং সিটে হিউগ ভ্যারাড। আবছা ধূসর আলোয় পেছনের সিটে বসা মিস মারভেলের মূর্তিটা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাথা ঝুলে পড়েছে বুকের কাছে, বার বার চোখের কাছে হাত নিয়ে। যাচ্ছে, নিশ্চয় রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে। ধরে ধরে তাকে নামাল ভ্যারাড। গুঞ্জন উঠল গেটের পাল্লায়, খুলে গেল, ভেতরে ঢুকল তিনজনে।
মিনিট কয়েক পরে ফেকাসে-নীল একটা ক্যাডিলাক এসে থামল। হালকা-পাতলা একজন লোক নামল গাড়ি থেকে, বাদামী চুল। গেটের
কাছে গিয়ে রিসিভার বের করে কানে ঠেকাল।
একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে রবিন; যে ঝোপে রয়েছে, সেখান থেকেও কথা স্পষ্ট শোনা যায় না। ঝুঁকি নিল। নিঃশব্দে বেরোল ঝোঁপ থেকে, পা টিপে টিপে এসে থামল লোকটার পেছনে।
লোয়ার সার্কেলে নেমে যাব আমি, বলেই রিসিভার রেখে দিল। লোকটা।
গুড ইভনিং, বলল রবিন।
ঝট করে মুখ ফেরাল লোকটা।
এটা কি আঠারোশো বত্রিশ টরেনটি সার্কেল?
না। এটা টরেনটি ক্যানিয়ন ড্রাইভ। রাস্তা ভুল করেছ।
গুঞ্জন তুলে খুলে গেল পাল্লা। লোকটা ভেতরে ঢুকে যেতেই আবার বন্ধ হয়ে গেল।
প্রথম ঝোঁপটায় ফিরে এল রবিন। লোয়ার সার্কেলে নেমে যাব আমি।
হাঁ করে চেয়ে রইল অন্য তিনজন।
বুঝলে না? হাসল রবিন। এটা ওদের কোড। দারোয়ান বলে: অন্ধকার রাত। তার জবাবে বলতে হবে: লোয়ার সার্কেলে নেমে যাব আমি।
তা হলে আর দেরি কেন? জিনা বলল। চলো নেমে যাই।
গেটের কাছে এসে দাঁড়াল চারজনে। রিসিভার কানে ঠেকাল কিশোর। ভেসে এল একটা খসখসে গলা: অন্ধকার রাত! কণ্ঠস্বর যতখানি সম্ভব ভারি করে তার জবাব দিল কিশোর।
ক্লিক করে কেটে গেল কানেকশন। রিসিভার রেখে দিল কিশোর। মুহূর্ত পরেই গুঞ্জন তুলে খুলতে শুরু করল পাল্লা।
জিনাকে নিয়ে ঢুকে পড়ল তিন গোয়েন্দা। পেছনে বন্ধ হয়ে গেল। পাল্লা। হ্যাঁণ্ডেল টেনেটুনে দেখল রবিন, নড়ল না দরজা।
ওভাবে টানাটানি করে লাভ নেই, খুলবে না, মুসা বলল। গেটের এক পাশে আইভি লতার ঝাড় দেখাল। ওর ভেতরে দেয়ালে একটা খোপ আছে, তাতে সুইচ-টুইচ কিছু একটা আছে। সেদিন রাতে দারোয়ান ব্যাটাকে খুলতে দেখছিলাম।
ভুরু কুঁচকে আইভি-ঝাড়ের দিকে তাকাল রবিন। তাই! তার মানে কোন ধরনের সারকিট ব্রেকার!
আহাহা, হাত দিয়ো না! বাধা দিল কিশোর। অ্যালার্ম কানেকশন থাকতে পারে, বেজে উঠবে! কোথায় আছে জানলাম তো, জরুরি দরকার পড়লে খুলে বেরিয়ে যেতে পারব।
চলো, ব্যাটারা কী করছে দেখি! তাড়া দিল জিনা।
না, এখুনি বাড়ির ভেতরে ঢুকব না, কিশোর বলল। মেহমানরা সবাই আসেনি। আসুক, তারপর।
বাড়ির এক কোণে একটা অন্ধকার জায়গায় লুকিয়ে রইল, ওরা। চোখ গেটের দিকে। খানিক পর পরই খুলতে লাগল গেট, মেহমানরা ঢুকল। পনেরো মিনিটে আরও আটজন লোক এল, লম্বা গাড়িপথ ধরে চলে গেল বাড়ির ভেতরে।