মোড়ের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল আলুসা।
কিশোর, মেরি চাচী বললেন। মেয়েটার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিস না। তোর তো যতসব উদ্ভট কাণ্ড! রাস্তার ওপারে বাড়ি, হাজার হোক আমাদের প্রতিবেশী।
কিন্তু প্রতিবেশীসুলভ ব্যবহার তো করে না, সাফ জবাব দিল। কিশোর। ঘোড়াটা ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথা বলে বলেও মনে হয় না।
বেশি লাজুক আরকী।
জবাব দিল না কিশোর, পথের মাথায় মুসা আর রবিনকে দেখা যাচ্ছে। সাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতা লাগিয়েছে যেন দুজনে। ওরাও তার মতই স্পোর্টস শার্ট গায়ে চড়িয়েছে, নিচে সাতারের। পোশাক, পায়ে স্নিকার।
আমি যাই, চাচীকে বলেই আর দাঁড়াল না কিশোর, বেরিয়ে এল। ঘর থেকে।
সাইকেল নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিল কিশোর। এবারে সত্যিই প্রতিযোগিতা শুরু হলো। সাই সাই প্যাডাল ঘুরিয়ে অন্য দুজনের আগে চলে এল সে। এমনিতে মুসার সঙ্গে পারার কথা নয় কিশোরের, কিন্তু মুসা আর রবিন অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে, আর সে সবে শুরু করেছে। চালানো।
দেখতে দেখতে পথের মোড়ে পৌঁছে গেল ওরা। ছোট্ট পাহাড়ের জন্যে ওপাশের কিছু দেখা যায় না, সৈকতের দিকে চলে গেছে যে সড়কটা, ওটাও চোখে পড়ে না।
হঠাৎ, হেইই, কিশোর! বলে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
কিশোরও দেখেছে, কিন্তু সামলে নেয়ার সময় পেল না। সামনে আচমকা বিশাল মূর্তিটা উদয় হতেই সাইকেলের কথা ভুলে গিয়ে আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে দুহাত মাথার ওপর তুলে ফেলল সে, ভারসাম্য হারিয়ে হুড়াম করে কাত হয়ে পড়ে গেল এক পাশে। উরুর ফাঁক থেকে ঝনঝন শব্দ তুলে পিছলে সরে গেল সাইকেল।
উঁচু পর্দায় চিৎকার শোনা গেল, ঘোড়ার ডাক নয়, মেয়ে কণ্ঠ।
মুহূর্ত পরেই আলকাতরা মেশানো পথের নুড়িতে নাল লাগানো ঘোড়ার খুরের বিচিত্র শব্দ উঠল, ব্রেক কষে নিজেকে থামানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে জানোয়ারটা। ঠিক চোখের সামনে খুর দুটো দেখতে পেল কিশোর। দ্রুত এক গড়ান দিয়ে পাশে সরে গেল সে, তারপর উঠে বসল।
পেছনের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে আপালুসা, নামিয়ে আনছে সামনের পা। দুকান লেপ্টে আছে মাথার সঙ্গে। পথের ওপর চিৎপাত হয়ে আছে পারকারদের মেয়ে।
মাটিতে সাইকেল শুইয়ে রেখে সাহায্য করতে ছুটে গেল মুসা আর রবিন। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে কিশোরও ছুটল।
নিচু হয়ে জিনার কাঁধে হাত রাখল মুসা।
হাঁপাচ্ছে মেয়েটা, হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। চেঁচিয়ে উঠল, হা-হাত সরাও!
ইলেকট্রিক শক খেল যেন মুসা, হাত সরিয়ে আনল।
খুব বেশি লেগেছে? মেয়েটার দিকে ঝুঁকে মোলায়েম গলায় প্রশ্ন করল রবিন।
কোনমতে উঠে বসল জিনা। হাঁটু চেপে ধরে রেখেছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত, জিনসের প্যান্টের এক হাঁটুর কাছে ছেঁড়া, জায়গাটার চারপাশ ভিজে গেছে রক্তে। কান্নার মত ফোপানি বেরোচ্ছে তার গলা থেকে, কিন্তু চোখ শুকনো, কাঁদছে না। হাপাচ্ছে। এখনও।
নাহ, সত্যিই খুব চোট পেয়েছ! গলায় সহানুভূতি ঢালল মুসা।
মুসার কথায় কানই দিল না জিনা, কড়া চোখে তাকাল কিশোরের দিকে। হঠাৎ সামনে কিছু দেখলে চমকে ওঠে ঘোড়া, জানো না!
সরি! বলল কিশোর। আমি দেখিনি।
আস্তে করে উঠে দাঁড়াল জিনা। ঘোড়াটাকে এক নজর দেখে আবার কিশোরের দিকে ফিরল। মেয়েটার চুলের রঙের মতই চোখের মণিও তামাটে, জ্বলছে। যদি আমার ঘোড়ার কোন কিছু হয়… দাঁতে দাঁত চাপল মেয়েটা।
মনে হচ্ছে হয়নি, ভোতা গলায় বলল কিশোর।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে আপালুসার পাশে গিয়ে দাঁড়াল জিনা। গায়ে হাত রাখল। লক্ষ্মী মেয়ে! শান্ত হও!
বিশাল থুতনি জিনার কাঁধে রাখল আপালুসা।
খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছে তোমাকে, না? আস্তে করে ঘোড়ার মাথায় চাপড় দিল জিনা।
পথের মাথায় মেরি চাচীকে দেখা গেল, চেঁচামেচি শুনে ছুটে এসেছেন। এই, কিশোর! কী হয়েছে রে?
রাশ ধরে ঘোড়ার পাশে চলে এল জিনা, পিঠে চড়ার ইচ্ছে। কিন্তু আরোহী নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করল ঘোড়া, পিছিয়ে গেল এক পা।
মুসা, কিশোর বলল। রাশটা সামনের দিকে টেনে ধরো তো। আমি ওকে তুলে দিচ্ছি।
হয়েছে হয়েছে, কারও সাহায্য লাগবে না আমার! খেঁকিয়ে উঠল জিনা।
কাছে এসে দাঁড়ালেন মেরি চাচী। জিনার উস্কোখুস্কো চুল, ধূলি ধূসরিত মুখ, ছেঁড়া প্যান্ট, রক্তাক্ত হাঁটু দেখলেন। কী হয়েছে?
ও আমার ঘোড়াকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে, কিশোরকে দেখিয়ে। গোমড়া মুখে বলল জিনা।
জিনা পড়ে গিয়েছিল, যোগ করল মুসা।
ইচ্ছে করে করিনি, বলল কিশোর। এত বড় একটা জানোয়ার যে এমন ভীতুর ডিম, তাই বা কে জানত!
এই, চুপ কর! কিশোরকে ধমক দিলেন মেরি চাচী। যা, দি গিয়ে তোর চাচাকে বল পিকআপটা নিয়ে আসতে
মেয়েটার হাঁটুর যা
অবস্থা, ঘোড়ায় উঠতে পারবে না।
না, না, পারব, প্রতিবাদ করল জিনা।
কানেই তুললেন না চাচী। কিশোরকে বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মুসার দিকে ফিরলেন। তুমি লাগামটা ধরো তো শক্ত করে। জিনার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে, দেখছ না।
ভয়ে ভয়ে ঘোড়াটার দিকে তাকাল মুসা। যদি কামড়ায়?
আরে, নাহ, কামড়াবে না! ঘোড়ার ব্যাপারে তার জ্ঞান কতখানি, ভুলে প্রকাশ করে দিলেন মেরি চাচী। ঘোড়া কামড়ায় না। তবে লাথি মারে।
খাইছে! গুঙিয়ে উঠল মুসা।
দুই
ঘোড়াটাকে পারকার হাউসে নিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। গাড়ি-বারান্দায় স্যালভেজ ইয়ার্ডের পিকআপটা দাঁড়িয়ে আছে, মেরি চাচী কিংবা জিনাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও।