সাবধানে দেয়ালের পাশ দিয়ে হেঁটে চলল তিন গোয়েন্দা, মাঝে মাঝেই থেমে কান পাতছে। কোনরকম আওয়াজ আসছে না দেয়ালের ওপার থেকে। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রবিন, লাফিয়ে সরে গেল এক পাশে, পায়ের ওপর এসে পড়েছে একটা ছোট্ট জানোয়ার, ভয় পেয়ে ঝোঁপঝাড়ের ভিতরে ছুটে পালাল ওটা।
শেয়াল, বলে উঠল মুসা।
দেখেছ? জানতে চাইল রবিন।
না। কিন্তু শেয়ালই তো হওয়া উচিত!
চুপ! চাপা গলায় হুশিয়ার করল কিশোর।
দেয়ালের ধার ধরে বাড়ির পুরো সীমানায় চক্কর দিয়ে এল ওরা, কিন্তু আর কোন গেট পাওয়া গেল না। যেখান থেকে শুরু করেছিল, আবার সেখানে এসে দাঁড়াল। বাড়ির ভিতর ঢোকার কোন পথ খুঁজে পেল না গোয়েন্দারা; শুধু জানল, বিরাট সীমানা, আশপাশ নির্জন, কাছেপিঠে আর কোন বাড়ি-ঘর নেই। অন্ধকার ঘন হয়েছে আরও, আলোর কোন চিহ্ন নেই এখন ও-বাড়িটাতে।
দেয়াল ডিঙাতে হবে, মুসা, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কিশোর। আমার আর রবিনের কাঁধে চড়ে উঠে যাও।
ইয়াল্লা! বলে কী! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। মাথা খারাপ!
আর কোন উপায় নেই, মুসার কথা কানেই নিল না কিশোর। তুমি উঠলে আমি চেষ্টা করব। কিন্তু, কাজটা তোমারই করা উচিত। তুমি উঠলে আমাকে আর রবিনকে টেনে তুলতে পারবে। আমি বা রবিন, কেউই তোমাকে তুলতে পারব না। বাড়িটাতে ঢোকার এই একটাই উপায়।
অনেক বারের মত আরেকবার নিজেকে মনে মনে গাল দিল মুসা: কেন মরতে তিন গোয়েন্দায় যোগ দিয়েছিল! কিন্তু সত্যিই কি ঢুকতে চাই আমরা? বলেই বুঝল, অহেতুক মুখ নষ্ট। রবিনকে টেনে নিয়ে দেয়ালের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে কিশোর, দুজনের কাঁধে দুজনে হাত রেখে চমৎকার একটা মাচা তৈরি করে ফেলেছে।
কী আর করবে? বিড়বিড় করে নিজের ভাগ্যকেই বোধহয় একটা গাল দিয়ে এসে মাচায় উঠল মুসা। দেয়ালের মাথা দুহাতে ধরে মুখ বাড়িয়ে দিল সামনে। অন্ধকার বাড়িটার দিকে চোখ রেখে দুহাতে ভর দিয়ে এক ঝাঁকুনিতে উঠে বসল দেয়ালের ওপরে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘটল ঘটনা। কান ফাটানো তীক্ষ্ণ আওয়াজে বেজে উঠল অ্যালার্ম বেল।
জলদি নামো! মুসার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
জ্বলে উঠল ফ্লাডলাইট, একসঙ্গে, আটটা, দেয়ালের একেক কোণে দুটো করে। দেয়ালের মাথা আঁকড়ে ধরে বসে আছে মুসা, তীব্র নীলচে সাদা আলো ধাঁধিয়ে দিচ্ছে চোখ, পাতা মেলে রাখতে পারছে না।
লাফ মারো! আবার চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
তাড়াহুড়ো করে ঘুরে বসতে গিয়ে হাত পিছলাল মুসার, সামলানোর চেষ্টা করল, পারল না, পড়ে গেল ধুপপ করে। এপাশে নয়, দেয়ালের ওপাশে!
সাত
নরম ঘাসের ওপর চিত হয়ে পড়েছে মুসা, তাই ব্যথা পেল না। পড়েই এক গড়ান দিয়ে হাঁটুতে ভর করে উঠে বসল। থেমে গেছে বেল। চোখ পিটপিট করল সে, আশপাশে কী আছে দেখার চেষ্টা করল।
গাঁট্টাগোট্টা একজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে।
চোর কোথাকার! চেঁচিয়ে উঠল গার্ড, কণ্ঠস্বরে কিছু একটা রয়েছে, শিরশির করে উঠল মুসার মেরুদণ্ডের ভিতর। মতলব কী?
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলল, কিন্তু শব্দ বেরোল না, গলার ভিতরটা খসখসে শুকনো-সিরিশ কাগজ দিয়ে ঘষে দিয়েছে যেন কেউ। উঠে দাঁড়াতে গেল, কিন্তু এক হাঁটুতে ভর রেখে থেমে গেল মাঝপথেই, শাসানোর ভঙ্গিতে এক পা সামনে বেড়েছে লোকটা।
মুসাআ? ওপার থেকে শোনা গেল কিশোরের ডাক। পেয়েছ ওকে?
ভুরু কুঁচকে তাকাল গার্ড। কে? দ্রুত গেটের দিকে এগোল।
গেটের সামনে দেখা গেল কিশোরকে। এই যে, মিস্টার, ওকে দেখেছেন?
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন মুসার। অভিনয় শুরু করেছে শক্তিমান অভিনেতা।
কাকে? কিছুই বুঝতে পারছে না গার্ড।
হুগো।
মুসার দিকে তাকাল গার্ড।
আরে, না না, ও না, হাত নাড়ল কিশোর। বেড়াল। একটা হুলো, সিয়ামিজ ক্যাট। আমার মা এখনও জানে না ওটা হারিয়েছে। আপনাদের দেয়ালের ওপাশে যেতে দেখেছি।
ভাল গপ্পো! লোকটা ভয়ানক গম্ভীর।
সত্যি বলছি, গার্ডকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করছে কিশোর। হয়তো কোন গাছে উঠে বসে আছে।
এমনভাবে বলছে কিশোর, মুসারই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। ঘাড়ে নেমে আসা ধূসর চুলের বোঝায় আঙুল চালাল লোকটা, মুসার দিকে ফিরল।ওঠো! হাতের নির্দেশে গেট দেখাল। বেরোও!
উঠে দাঁড়াল মুসা।
প্লিজ! অনুনয় ঝরল কিশোরের কণ্ঠে। একটু সাহায্য করুন। বেড়ালটাকে একবার খুঁজেই বেরিয়ে আসবে আমার বন্ধু।
বেড়াল নেই! মুসার কনুই ধরে টেনে গেটের কাছে নিয়ে এল গার্ড।
মা আমাকে মেরে ফেলবে, কেঁদেই ফেলবে যেন কিশোর।
আমাকে মারারও লোক আছে, বলল গার্ড। ধমকে উঠল, জলদি যাও এখান থেকে! নইলে পুলিশ ডাকব!
নিরাশ ভঙ্গিতে এক পা পিছিয়ে এল কিশোর। কড়া নজর লোকটার দিকে।
গেটের পাশে দেয়ালের ভিতরের দিকে আইভি লতার ঝাড়, তার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিল গার্ড। কিছু একটা করল, মৃদু ক্লিক শব্দ হলো। খুলে যেতে শুরু করল পাল।।
এক ধাক্কায় মুসাকে বাইরে বের করে দিল গার্ড। আর যেন ভিতরে দেখি! তা হলে কপালে ভীষণ দুঃখ আছে বলে দিলাম। আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গেট।
যদি বেড়ালটা দেখেন… শুরু করেই থেমে যেতে হলো কিশোরকে।
ভাগো! চেঁচিয়ে উঠল গার্ড।
ঘুরে হাঁটতে শুরু করল মুসা আর কিশোর। চলে এল রবিনের কাছে, তাকে দেখেনি গার্ড। ফ্লাডলাইট নিভে গেল, কালিগোলা অন্ধকার যেন গ্রাস করে নিল তিন কিশোরকে।