নাপতিনী, হাসল মুসা। বোরিস, আর কোন অসুবিধে হবে না। আপনার। অন্ধকারেও দেখা যাবে ওই লাল চুল, অনুসরণ করতে পারবেন সহজেই।
বোরিসও হাসল। কমলা গাড়িটাকে অনুসরণ করল। করভেটটাকে দেখা যাচ্ছে না, গিরিপথে মোড়ের ওপাশে হারিয়ে গেছে আবার। মোড় পেরোতেই ইটের উঁচু একটা দেয়াল চোখে পড়ল, পথের ওপর সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো গাড়ি। ওগুলোর পাশে থেমেছে করভেট, মিস মারভেল আর হিউগ ভ্যারাড় নামছে গাড়ি থেকে।
ঘাসে ঢাকা ঢালের গা ঘেঁষে গাড়িগুলোর দিকে পেছন করে ট্রাক রাখল বোরিস। জিনার খালা কিংবা ভ্যারাডের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে মাথা নিচু করে রেখেছিল তিন গোয়েন্দা, আবার সোজা হয়ে বসল।
রিয়ার ভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে আছে বোরিস। মিস মারভেলের দিকে হাত নাড়ছে গ্যানারিল।
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল রবিন আর মুসা।
আরে! ছাই রঙের স্যালুন! উত্তেজিত কণ্ঠে বলল রবিন। জিনাদের বাড়িতে যেটাকে দেখেছিলাম!
নিশ্চয় ওই নোংরা রাসলার, অনুমান করল মুসা। মেলা লোক। এসেছে তো আজ রাতে! গাড়িগুলোর দিকে চেয়ে আছে সে।
এগোরাটা, গুনে বলল বোরিস।
জেরি গ্যানারিল আর মিস মারভেলকে নিয়ে বিরাট লোহার গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ভ্যারাড। গেটের মাথায় লোহার চোখা শিক বসানো। দুই মহিলাকে কিছু বলে গেটের পাশের দেয়ালের কাছে সরে গেল ভ্যারাড। একটা খোপের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে কী যেন বের করে আনল।
টেলিফোন? আপন মনেই বাল রবিন।
টেলিফোনই। রিসিভার কানে ঠেকাল ভ্যারাড়, বোধহয় কিছু বলল, তারপর আবার রেখে দিল আগের জায়গায়। খানিক পরেই ঝনঝন করে খুলে গেল গেট। মহিলাদেরকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল ভ্যারাড, বন্ধ হয়ে গেল পাল্লা।
নীরবে অপেক্ষা করছে গোয়েন্দারা। আর কোন গাড়ি এল না। মিনিট পনেরো পর কেবিনের দরজা খুলল কিশোর। অতিথিরা সব এসে গেছে, আর কেউ আসবে না। কীসের বৈঠক, দেখা দরকার।
নেমে পড়ল তিন গোয়েন্দা। কিশোরকে অনুসরণ করে এগোল অন্য দুজন।
কারুকাজ করা পাল্লার একটা সর্পিল তামার পাতে হাত বুলিয়ে বলল রবিন, ইস, রাশেদ চাচা এ-জিনিস পেলে পয়সার দিকে চাইত না।
চকচকে পালিশ করা পিতলের হাতল ধরে জোরে টান দিল কিশোর, নড়ল না পাল্লা। তালা লাগানো। এটাই আশা করেছিলাম।
দেয়ালের খোপটা দেখছে মুসা। করে দেখব নাকি? ডায়াল নেই। বাড়ির ভিতরে সরাসরি কানেকশন।
পায়ে পায়ে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বোরিস। দেখো না করে।
হুকে ঝোলানো রিসিভারটা বের করে আনল মুসা। কানে ঠেকাতেই ক্লিক করে একটা শব্দ শুনল, তারপরই ভেসে এল ভারি কণ্ঠ, অন্ধকার রাত।
অ্যাঁ! থতমত খেয়ে গেল সহকারী গোয়েন্দা। রাত হয়নি এখনও, শিগগিরই হবে! ইয়ে, স্যর, একটা বিস্কুট কোম্পানি থেকে এসেছি…
আবার ক্লিক শব্দ করে নীরব হয়ে গেল ফোন, কানেকশন কেটে দিয়েছে।
বিস্কুট পছন্দ না ওদের, হাসল কিশোর, মুসার মুখ দেখেই বুঝেছে। কী ঘটেছে।
তাই তো মনে হচ্ছে, রিসিভার আগের জায়গায় রেখে দিল মুসা। তুলেই কী বলেছে জানো? অন্ধকার রাত!
কোন ধরনের কোড় ওয়ার্ড সদস্যরা জানে জবাবটা কী হবে।
পাল্লার ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি দিল রবিন। একটা আলোও নেই, এ কী-রকম বাড়ি!
এগারোটা গাড়ি, বিড়বিড় করল, কিশোর!
মিস মারভেলের গাড়িতে এসেছে দুজন, তার মানে অন্তত বারোজন অতিথি এসেছে আজ রাতে।
করছে কী ব্যাটারা? বোরিসের কণ্ঠে বিস্ময়। কিছু আলো তো অন্তত থাকবে!
মোটা পর্দা লাগিয়েছে হয়তো, কিশোর বলল।
তা ছাড়া মোম, জ্বালে ওরা, রবিন যোগ করল। ওদের কাছে মোম খুব প্রিয়। এত কম আলো পর্দা ভেদ করে আসতে পারছে না।
আবছা অন্ধকার পথে দাঁড়িয়ে আগের রাতের কথা ভাবছে তিন গোয়েন্দা, পারকার হাউসের ডাইনিং রুমের দৃশ্য ভেসে উঠেছে মনের পর্দায়: কাঁচের বাটিতে তরল পদার্থ, মেহমানদের হাতে হাতে ঘুরছে, মোমের আলোয় ঘরের দেয়ালে ছায়ার নাচন…তারপর, তারপর সেই অপার্থিব রক্ত হিম-করা বেসুরো গান..
আজ রাতেও শোনা যাবে না তো! হঠাৎ নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল মুসা।
কী শোনা যাবে? বুঝতে পারছে না বোরিস।
জানি না, মাথা নাড়ল কিশোর। ভ্যারাড় বলেছে মহাসর্পের কণ্ঠস্বর। কিন্তু এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে কিছুই জানতে পারব না।
আরও গেট থাকতে পারে, সম্ভাবনার কথা বলল রবিন।
তা পারে, সায় দিল কিশোর। হয়তো ওটাতে তালাও নেই। অনেকেই সামনের গেটে তালা লাগায়, পিছনের গেট এক্কেবারে খোলা থাকে। কতরকম মানুষ যে আছে! খামখেয়ালীপনা করে পুলিশের কাজ বাড়ায়।
চলো, দেখি, মুসা বলল।
বোরিস, গাড়িতে গিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে বসে থাকুন। আর হ্যাঁ, গাড়িটা গেটের আরও কাছে নিয়ে এলেই বোধহয় ভাল হয়। কীসের বৈঠক বসিয়েছে ব্যাটারা, কে জানে! ছুটে পালানোর দরকার পড়তে পারে আমাদের।
দ্বিধা করল বোরিস। কী ভাবল, তারপর বলল, ঠিক আছে।ট্রাকের দিকে রওনা হলো সে।
ইঞ্জিন স্টার্ট হলো, জ্বলে উঠল হেডলাইট। ট্রাকটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে এল বোরিস, গেটের সামনে দিয়ে গিয়ে ফুট পঞ্চাশেক দূরে পথের পাশে দাঁড় করাল। নিভে গেল আলো। উজ্জ্বল আলো হঠাৎ নিভে যাওয়ায় অন্ধকার অনেক বেশি মনে হচ্ছে এখন।
টর্চ আনা উচিত ছিল, আফসোস করল মুসা।
আনিনি যখন, বলে আর কী হবে? বলল কিশোর। তবে আনলেও জ্বালতাম না, ওদের চোখে পড়ত। চলো।