অ্যাই, তোমরা ওখানে কি করছ? নাকী একটা কণ্ঠ।
ঝট করে ফিরল তিন গোয়েন্দা। নিচে তাকাল। নিচের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে মিসেস ডেনভার। পরনে ড্রেসিং গাউন। লাল চুল এলোমেলো।
ছেলেরা চাইতেই জিজ্ঞেস করল মহিলা, মিস্টার অলিভার আছেন ঘরে?
মনে হচ্ছে না, জবাব দিল কিশোর।
এই সকাল বেলায় কোথায় বেরোলেন! নিজেকেই যেন, প্রশ্ন করল মিসেস ডেনভার।
জবাব দিল না তিন গোয়েন্দা। নামতে শুরু করছে সিঁড়ি বেয়ে। মিসেস ডেনভারের দিকে ফিরেও তাকাল না ওরা। পাশের সরু পথটা ধরে এগোল। একটা লঞ্জি আর একটা স্টোর রুম পেরিয়ে এল। বেরিয়ে এল পাশের গলিতে। অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের এক কোণে একটা ডাস্টবিন। পথের ওপাশে আরেকটা বাড়ি, দরজাটা গলি পথের দিকে ফেরানো।
গেটেই তামার ফলকে লেখা রয়েছে: ২১৩, লুকান কোর্ট। একতলা, প্রায় স্কয়ার সাইজের ছোট একটা বাড়ি।
ঘণ্টা বাজাল মুসা। খানিক খুলে গেল দরজা। দাঁড়িয়ে আছে মিকো ইলিয়ট। কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত চেহারা।
এস, একপাশে সরে ঢোকার জায়গা করে দিল মিকো।
শোবার ঘর আর স্টুডিওর মিশ্রণ বলা যায় এমন একটা ঘরে এসে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। সিলিংয়ে স্কাইলাইট। কার্পেট নেই মেঝেতে, আসবাবপত্রও খুব সামান্য। বড়সড় একটা ড্রইং টেবিল আর একটা ইজেল রাখা আছে এক জায়গায়। নানা। রকম ছবি আর স্কেচ ঝুলছে দেয়ালে, আস্তরই দেখা যায় না প্রায়। যেখানে সেখানে। বইয়ের স্তূপ। ছোট্ট একটা টেলিভিশন, বড়সড় দামি একটা রেকর্ড প্লেয়ার আর একগাদা রেকর্ড অযত্নে পড়ে আছে।
বড়সড় একটা ডিভানে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন মিস্টার অলিভার। মুখচোখ শুকনো। নিজেকে শান্ত রাখার জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি, দেখেই বোঝা। যায়। ছেলেদেরকে গুড মর্নিং জানালেন। বললেন, আরও একটা রহস্য যোগ হয়েছে। গতরাতে চোর ঢুকেছিল এ বাড়িতে। সর্বনাশ করে গেছে আমার।
ভেবে আর কি করবে, ফ্র্যাঙ্ক, সান্তনা দিল মিকো। এটা নিতান্তই দুর্ঘটনা। পুলিশ তাড়া না করলে আরও কিছু নিয়ে যেত ব্যাটা। ছেলেদের দিকে ফিরল সে। ফ্র্যাঙ্কের কাছে শুনলাম, তোমাদের নাকি গোয়েন্দা হওয়ার শখ। এখানে তেমন রহস্যজনক কিছু পাবে বলে মনে হয় না। রান্নাঘরের জানালা খুলে ঢুকেছিল চোর। গ্লাস-কাটার দিয়ে কাঁচ কেটে ভেতরে হাত ঢুকিয়েছে। খুলে ফেলেছে ছিটকিনি। তারপর হাউণ্ডটা নিয়ে বেরিয়ে চলে গেছে। খুব সাধারণ চুরি।
কিন্তু শুধু হাউণ্ডটাই নিয়ে গেছে ব্যাটা! বলে উঠলেন অলিভার।
ওতে অস্বাভাবিক কিছু নেই, পুলিশের তাই ধারণা, বলল মিকো। তাছাড়া ওটা ছাড়া ঘরে মূল্যবান আর কিছু নেইও। টেলিভিশনটা, মাত্র নইঞ্চি স্ক্রীন, কোন দামই নেই ওটার। রেকর্ড প্লেয়ারের বডি আর স্পীকারের ফ্রেমে আমার ভাইয়ের নাম খোদাই করা আছে। নিয়ে গেলেও বিক্রি করতে পারত না ওটা। এছাড়া নেবার মত আর কি আছে? জানই তো খুব সাধারণ জীবনযাপন করত আমার ভাই।
অনেক বড় শিল্পী ছিল ও, অলিভারের কণ্ঠে গভীর শ্রদ্ধা। বেঁচে ছিল শুধু। শিল্পসৃষ্টি নিয়েই। দুনিয়ার আর কোনদিকে খেয়াল থাকলে তো!
হাউণ্ডটা কি জিনিস? জানতে চাইল মুসা।
মৃদু হাসল মিকো। একটা কুকুরের মূর্তি। এমন একটা কুকুর, যার কোন অস্তিত্ব নেই। বেঁচে আছে শুধু কুসংস্কারে বিশ্বাসী কিছু মানুষের মনে। খুব রোমাঞ্চপ্রিয় ছিল আমার ভাই, রোমান্টিকতা ফুটিয়ে তুলেছে তার প্রতিটি শিল্পকর্মে। ভূতুড়ে কুকুরের কাহিনী নিশ্চয়ই শুনে থাকবে। কার্পাথিয়ান পর্বতমালার পাদদেশে তেমনি একটা কুকুরের কাহিনী শোনা যায়।
হ্যাঁ, মাথা ঝোকাল কিশোর। জায়গাটার নাম ট্রানসিলভানিয়া। ব্রাম। স্টোকারের ড্রাকুলা ওখানেই বাস করত।
ঠিক, বলল মিকো। কিন্তু ওই কুকুরটা রক্তচোষাও না, মায়ানেকড়েও না। ওই গাঁয়ের লোকের ধারণা, ওটা আসলে এক জমিদারের প্রেতাত্মা, কুকুরের রূপ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এ-সম্পর্কে চমৎকার একটা গল্পও আছে। ওই জমিদার ছিল দুর্ধর্ষ শিকারী, একপাল ভয়ঙ্কর আধবুনো কুকুর ছিল তার। নেকড়ের রক্ত ছিল কুকুরগুলোর শিরায়। জানোয়ারগুলোকে সব সময় তৎপর রাখার জন্যে পুরোপুরি খেতে দিত না লোকটা। একদিন, পেটে খিদে নিয়ে কি করে জানি খেয়াড় থেকে বেরিয়ে পড়ল একটা কুকুর।
সর্বনাশ! বিড়বিড় করল রবিন।
হ্যাঁ, বেরিয়ে পড়ল। তারপর ঘটল মর্মান্তিক ঘটনা। এটা কিন্তু সত্যি, বানানো নয়। একটা শিশুকে খুন করে বসল কুকুরটা। রাগে কাঁপতে কাঁপতে জমিদারের। কাছে ছুটে এল সন্তানহারা পিতা। সবগুলো নেকড়ে-কুকুরকে মেরে ফেলার দাবি জানাল। প্রত্যাখ্যান করল জমিদার। উল্টে, টিটকিরি দিয়ে বলল, চাইলে শিশুটার। বিনিময়ে কয়েকটা পয়সা দিতে পারে সে বাপকে। আর রাগ সামলাতে পারল না বাবা। বিশাল এক পাথর তুলে নিয়ে আক্রমণ করল জমিদারকে। মারা গেল। জমিদার। মৃত্যুর আগে অভিশাপ দিয়ে গেল। আবার সে আসবে গাঁয়ে, অন্য রূপে। গায়ের কাউকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।
তারপর নিশ্চয় কুকুর হয়ে ফিরে এসেছিল লোকটা? বলল মুসা।
হ্যাঁ। এক বিশাল হাউণ্ড, আগের কথার খেই ধরল মিকো, জমিদারের সবকটা কুকুরকে মেরে ফেলল গাঁয়ের লোকজন। তারপর, এক অন্ধকার দুর্যোগের রাতে ঘটল ঘটনা। বিরাট এক কুকুরকে দেখা গেল গাঁয়ের পথে। গোঙাচ্ছিল, মাঝে মাঝেই হাঁক ছাড়ছিল ক্ষুধার্ত কণ্ঠে। চামড়ার ওপর দিয়ে পাঁজরার হাড় গোনা যাচ্ছিল। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল লোকেরা। দুএকজন দুঃসাহসী লোক খাবার এনে। রাখল কুকুটার সামনে। কিন্তু চুলোও না হাউণ্ডটা। কারও কোন ক্ষতিও করল না। এরপর থেকে প্রতি অমাবস্যার রাতেই নাকি ফিরে আসতে লাগল কুকুরটা। লোকজন গ্রাম ছেড়ে পালাল। আজও নাকি দেখা দেয় ওই কুকুর। পোড়ো গ্রামটায় ঘুরে ঘুরে বেড়ায় অন্ধকার রাতে, হাঁক ছাড়ে ক্ষুধার্ত গলায়। হতে পারে, কাহিনীটা। বানানো। রোমাঞ্চকর এক ভূতুড়ে গপ্পো!