.
১৯.
বিকেল চারটে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
রেকটরির পাশের ছোট্ট ফুলের ঝোপে লুকিয়ে বসে আছে তিন গোয়েন্দা। রাস্তার ধারের ছোট পাকটা নির্জন। শুধু একজন ঝাড়দার রয়েছে। একটা ঝুড়ি আর ঝাড় হাতে নিয়ে পার্কের ময়লা পরিষ্কার করছে। চকলেটের মোড়ক, বিস্কুটের বাক্স, ছেঁড়া কাগজের টুকরো-টাকরা ইত্যাদি তুলে নিয়ে রাখছে ঝুড়িতে। ভরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেবে ডাস্টবিনে।
উইলশায়ারের দিক থেকে আসবে চোর, ফিসফিস করে বলল কিশোর।
একটা খবরের কাগজের ভ্যান এসে থামল পার্কের গেটের সামনে। পেছন। থেকে লাফিয়ে নামল, একজন হকার, বগলে একগাদা কাগজ। পথের পাশের ফুটপাতে কাগজগুলো সাজিয়ে রাখতে শুরু করল। চলে গেল ভ্যানটা। খদ্দেরের অপেক্ষা করছে হকার। পরিচিত দৃশ্য।
ছেলেদের মাথার ওপরে নিঃশব্দে খুলে গেল একটা জানালা। মনে হয়, শোনা গেল একটা পরিচিত কণ্ঠ, তোমরা আমার ঘরে এসে বসলেই বেশি আরাম পাবে। বাইরে ঠাণ্ডা।
মুখ তুলে তাকাল মুসা। খোলা জানালায় মুখ বাড়িয়ে আছে ফাদার স্মিথ। দাঁতের ফাঁকে পাইপ। ওই ঝোঁপের ভেতরে কেন? ঘরে এস। সামনের দরজা খুলে দিচ্ছি। ঘুরে চল এস।
অনুভব করল কিশোর, ঝাঝা করছে কান।
এত ছোট ঝোপে লুকোনো যায় না, আবার বললেন ফাদার। দেখে ফেলবেই। চলে এস। আবার পুলিশের কাজে নাক গলাচ্ছ, দেখলে খেপে যাবে ওরা।
আর কি করবে? উঠে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। রেকটরির পাশ ঘুরে এসে দাঁড়াল। সদর দরজার সামনে। খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকে পড়ল তিন গোয়েন্দা।
তোমাদেরকে আসতে দেখেছি, বললেন ফাদার। ওই যে দুজন লোক, একজন ঝাড়দার, আরেকজন হকার, কারও জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা। ব্যাপারটা কি? গির্জায় চোর ঢোকার সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে?
ওরা দুজন কারও অপেক্ষা করছে, কি করে জানলেন? পাল্টা প্রশ্ন করল। কিশোর। আমরা তো বুঝতে পারিনি!
একজনকে চিনি আমি, হাসলেন ফাদার। ছদ্মবেশ নিয়েও ফাঁকি দিতে পারেনি আমাকে। সার্জেন্ট হোন। হাসপাতালে পলকে জেরা করতে গিয়েছিল। ওখানেই ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আমার। অন্য লোকটাকে চিনি না। তবে হকার সে নয়, বাজি রেখে বলতে পারি।
ধর্মপ্রচারে না এসে ডিটেকটিভ হওয়া উচিত ছিল আপনার, ফাদার! বলে উঠল রবিন। পল কেমন আছে?
ভালই। চোর ওকে মেরেছে, এতে দুঃখ পাওয়ার চেয়ে খুশিই হয়েছে সে বেশি। খবরের কাগজে নাম উঠেছে তার। বোকা গাধা!দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপ সরালেন ফাদার। বোকা মেয়ে মানুষটাও নেই আজ, বিকেলটা ছুটি। কোথায় জানি গেছে। এখানে, এই পার্লারে দাঁড়িয়ে পাইপ টানতে পারছি সেজন্যেই। নইলে এতক্ষণে চেঁচিয়ে আমার মাথা খারাপ করে দিত।
হেসে ফেলল কিশোর। হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। পাঁচটা বাজে প্রায়!
ঘোষণা করল সে।
মিস্টার অলিভারকে আসতে দেখা গেল, তাতে বাদামী কাগজের প্যাকেট। পার্কে যাওয়ার রাস্তাটার মাথায় এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কোণের দিকে একটা ডাস্টবিন, উপচে পড়ছে, এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে ওটার সামনে দাঁড়ালেন অলিভার। এদিক-ওদিক তাকালেন, তারপর কয়েকটা বাক্সের ওপর আস্তে করে রেখে দিলেন প্যাকেটটা। আর কোনদিকে না তাকিয়ে হন হন করে হেঁটে ফিরে আসতে লাগলেন।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উইলশায়ারের রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো লোকটা হাঁটতে শুরু করল। ভবঘুরে। ছেঁড়া ময়লা কোট, নিচে শার্ট নেই। প্যান্টের এক পায়ের নিচের দিকে ঝুল প্রায় আধ হাত নেই, ছিঁড়ে পড়ে গেছে কোন্ কালে।
আহা! আস্তে মাথা নাড়লেন ফাদার। বেচারা!
পার্কের গেটের দিকে এগোচ্ছে ভবঘুরে। তার কাছ থেকে কয়েক গজ দূরে রয়েছে ঝাড়দার। নুয়ে ঘাসের ওপর পড়ে থাকা কি যেন তুলছে। কাগজ গুনছে হকার।
ডাস্টবিনের কাছে এসে দাঁড়াল ভবঘুরে। ডাস্টবিন ঘাঁটতে শুরু করল। পরিত্যক্ত খাবার খুঁজছে যেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। হাতে বাদামী প্যাকেট। চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল ওটা তার কোটের ভেতরে।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল হকার। ছুটল ভবঘুরের দিকে।
হাত থেকে ঝাড়-ঝুড়ি ফেলে দিয়ে ছুটল সার্জেন্ট হেগান।
দুটো লোককে প্রায় একই সঙ্গে ছুটে আসতে দেখল ভবঘুরে। ঘুরেই সে ছুটল উল্টো দিকে। জানালার চৌকাঠে উঠে গেল মুসা। লাফিয়ে পড়ল বাইরে, মাটিতে।
তীব্র হর্ন বাজাল একটা ছুটন্ত কার, কোনমতে পাশ কাটিয়ে ভবঘুরেকে ধাক্কা দেয়া এড়াল। কেয়ারই করল না লোকটা। ছুটছে প্রাণপণে।
প্রায় লাফিয়ে এসে রাস্তায় উঠল মুসা, ছুটল। চেঁচিয়ে উঠল একজন পুলিশ, রিভলভারের মুখ আকাশের দিকে করে বাতাসে গুলি ছুঁড়ল। রাস্তার মোড়ে পৌঁছে গেছে ভবঘুরে, ডানে ঘুরে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আর থাকতে পারছি না, ফাদার! বলেই জানালার চৌকাঠে উঠে বসল কিশোর। লাফিয়ে নামল মাটিতে। ছুটল। তাকে অনুসরণ করছে রবিন।
এই যে, ছেলেরা! চেঁচিয়ে উঠল একজন পুলিশ, যে হকারের ছদ্মবেশ নিয়েছে, পথ থেকে সর! গোলাগুলি চলতে পারে!
শাঁ করে মোড় নিল একটা স্কোয়াড কার, টায়ারের কর্কশ শব্দ উঠল। কাছে চলে এল নিমেষে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে আছে একজন পুলিশ। চেঁচিয়ে তাকে বলল সার্জেন্ট হেগান, সামনের মোড়ের দিকে গেছে!
দাঁড়ান! পেছন থেকে চেঁচিয়ে ডাকল কিশোর।
ফিরে তাকাল সার্জেন্ট। গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়েছে। কিশোরের গলা শুনে দাঁড়িয়ে গেছে মুসাও।