পুলের ঠিক মাঝখানে দেখা গেল একটা মাথা, আবছা! পরক্ষণেই ডুবে গেল। পানির নিচে দেখা গেল আলোর রশ্মি। পানি-নিরোধক টর্চ। নড়াচড়া করছে রশ্মিটা।
হঠাৎ নিবে গেল আলো। পানির ওপরে প্রায় নিঃশব্দে ভেসে উঠল আবার মাথাটা।
যেখান দিয়ে নেমেছিল, সেখান দিয়েই আবার উঠে পড়ল ছায়াটা। ফিরে চলল। মৃদু শব্দ হল দরজা খোলা এবং বন্ধ হবার।
আস্তে করে দরজায় টোকা দিল মুসা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খুলে গেল দরজাটা। টমি! ফিসফিস করে বলল সে।
দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল তিন গোয়েন্দা। পেছনে মিস্টার অলিভার আর মিকো ইলিয়ট।
অন্ধকারই রয়েছে টমির জানালা।
ছায়া শরীরে বেরিয়েছিল হয়ত! ফিসফিস করল মুসা।
মোটেই না! সবার আগে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে কিশোর। বেল বাজাল। এক সেকেণ্ড অপেক্ষা করে আবার বাজাল। গিলবার্ট! ডাকল চেঁচিয়ে। গিলবার্ট, দরজা খুলুন! নইলে পুলিশ ডাকব। ওরা দরজা ভেঙে ঢুকবে।
দরজা খুলে গেল। ঘুমোনর পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে টমি। খালি পা, আবছা দেখা যাচ্ছে। কি হয়েছে? মাঝরাতে ডাকাডাকি কেন? ঘুমিয়েছিলাম…।
ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে দিয়েছে কিশোর। আলো জ্বলে উঠল। ঘাড়ের ওপর। লেপটে আছে টমির ভেজা চুল।
ঘুমোননি, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। পুলে নেমেছিলেন।
না-আ! আমি— থেমে গেল টমি। চুল বেয়ে টপ করে পানি পড়েছে এক ফোঁটা। আমি শাওয়ারে গোসল করছিলাম।
আগে বললেন ঘুমিয়েছিলেন, এখন শওয়ার। দুটোই মিথ্যে কথা, শুধরে দিল কিশোর। আসলে পুলে নেমেছিলেন। পুলের ধার থেকে আপনার দরজা পর্যন্ত এসেছে ভেজা পায়ের ছাপ।
দরজার বাইরে তাকাল টমি। সত্যিই, দরজায় ভেজা ছাপ। কাঁধ ঝাঁকাল সে। বেশ, নেমেছিলাম পুলে। তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল? সারাদিন। পরিশ্রম করেছি, সাঁতার কেটে শান্ত করে নিয়েছি শরীরটাকে।
হাউণ্ডটা কোথায়? প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন অলিভার। বজ্জাত! চোর!
কি যা-তা বলছেন! কিছুই বুঝতে না পারার ভান। কিন্তু সামাল দিতে পারল না টমি। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে চোখ, ঝট করে ঘুরে গেছে রান্নাঘরের দিকে।
কোন একটা তাকে রেখেছেন নিশ্চয়, রান্নাঘরের দরজার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। খুব বেশি তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। লুকোনর সময় পাননি।
মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার! বিড়বিড় করল টমি।
মিস্টার অলিভার, বলল কিশোর। পুলিশই ডাকুন। সঙ্গে একটা সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে আসতে বলবেন।
জোর করে কারও বাড়ি সার্চ করার নিয়ম নেই! বলল টমি। তাছাড়া মাঝরাতে ওয়ারেন্ট জোগাড় করতে পারবে না পুলিশ!
সেটা তাদের ব্যাপার, শান্ত কিশোর। না পারলে সকালতক অপেক্ষা করব। ইতিমধ্যে চত্বর থেকে নড়ছি না। আপনার ফ্ল্যাট ঘিরে রাখব আমরা। আমাদের চোখ এড়িয়ে বেরোতে পারবেন না, মূর্তিটা কোথাও ফেলেও দিয়ে আসতে পারবেন না।
তোমরা তোমরা তা করতে পার না! চেঁচাতে শুরু করেছে টমি। আমাকে, আমাকে অপমান করা হচ্ছে।
অপমান করলাম কোথায়? হাত নাড়ল কিশোর। চতুরে বসে থাকব আমরা, আপনার দরজার দিকে চেয়ে থাকব, এতে কোন দোষ ধরতে পারবে না উকিল। কেন অযথা ঝামেলা বাড়াচ্ছেন? মূর্তিটা দিয়ে দিন, আমরা সব ভুলে যাব। পুলিশ ডাকার দরকারই হবে না।
ঝাড়া কয়েক সেকেণ্ড কিশোরের দিকে চেয়ে রইল টমি। পিছিয়ে গেল দরজার কাছ থেকে। চুলোর ভেতরে রেখেছি। মুখ কালো হয়ে গেছে তার। খামোকা। এসব করতে গেলেন, মিস্টার অলিভার। মুর্তিটা আপনাকেই দিয়ে দিতাম।
ব্যঙ্গ করে হাসলেন অলিভার। তাই নাকি? নিশ্চয় দশ হাজার দেবার পর?
দশ হাজার! সত্যিই বিস্মিত হয়েছে টমি। কিসের দশ হাজার?
জানেন না? জিজ্ঞেস করল কিশোর। সত্যিই জানেন না টাকাটার কথা?
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল টমি। ভেবেছিলাম, মূর্তিটা মিস্টার অলিভারকে দিলে কিছু পুরস্কার পাব। কিন্তু দশ হাজার ডলার, জানতাম না!
টমির পাশ কাটিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলেন অলিভার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলেন আবার। হাতে হাউণ্ডের মূর্তি। কোমরে বাঁধা সুতো মূর্তির শরীরে পেঁচানো।
মিস্টার অলিভার, বলে উঠল কিশোর। টমি চোর নয়। ঘুমের ভেতরে তার ছায়া শরীর শুধু ঘুরে বেড়ায়, দেখে, শোনে। তার বেশি কিছু করতে পারে না।
চমকে উঠল টমি। ফেকাসে হয়ে গেল চেহারা। উঠল-নামল কণ্ঠা, ঢোক গিলেছে।
কি দেখেছিলেন, গিলবার্ট? প্রশ্ন করল কিশোর। ঘুমের ঘোরে মূর্তিটার ব্যাপারে কি দেখেছিলেন? কি শুনেছিলেন?
কাঁপছে টমি। ইচ্ছে করে দেখিনি, শুনিওনি! ছায়া শরীর ঘুরে বেড়ায়, এতে আমার কোন দোষ নেই! ওটা এক ধরনের স্বপ্ন!
কি দেখেছেন স্বপ্নে? আবার প্রশ্ন করল কিশোর।
একটা কুকুর, কাঁচের। দেখলাম, অনেক রাতে, অন্ধকারে পুলের ধারে এসে বসল একটা মানুষ। পানিতে নামিয়ে রাখছে কাঁচের কুকুরটা। মুখ ঢেকে রেখেছিল মানুষটা, চিনতে পারিনি।
আমার মনে হয়, সঙ্গীদের দিকে ফিরল কিশোর, টমি গিলবার্ট সত্যি কথাই বলছেন।
.
১৮.
রক্ত ফিরে আসছে টমির মুখে। দেখ, কিশোর, মূর্তিটা আমি পুল থেকে তুলে এনেছি ঠিকই। কিন্তু সত্যি বলছি, ওটা সকালেই দিয়ে দিতাম মিস্টার অলিভারকে। আমি ওটা চুরি করিনি।
বুঝতে পারছি, বলল কিশোর, আপনি করেননি। চুরিটা যখন হয়, আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন। তবে, মূর্তিটা তুলে সঙ্গে সঙ্গে মিস্টার অলিভারের কাছে যাওয়া উচিত ছিল। লুকিয়ে রাখলেন কেন? কাজটা অন্যায় করেছেন।