ভুসস করে ভেসে উঠল কিশোর। ডান হাতটা তুলল পানির ওপর। হাতে কিছু। একটা ধা।
পেয়েছে। পেয়েছে! প্রায় নাচতে শুরু করলেন অলিভার।
চুপ! আস্তে! থামিয়ে দিল তাঁকে মিকো।
পুলের কিনারে চলে এল কিশোর। জিনিসটা বাড়িয়ে দিল অলিভারের দিকে।
কাঁপা কাঁপা হাতে নিলেন অলিভার। অপূর্ব একটা শিল্পকর্ম। নিখুঁত সৃষ্টি। পেশীগুলো পরিষ্কার, প্রায় চৌকোনা ভোতা মাথাটাকে জ্যান্তই মনে হচ্ছে। বড় বড় চোখ দুটো সোনালি, দুই কশে সোনালি ফেনা। সামনের পায়ের নিচ থেকে কানের ডগার উচ্চতা ছয় ইঞ্চি। সামনের দুই পায়ের ফাঁকে ক্রিস্টালে তৈরি মানুষের খুলির একটা খুদে প্রতিকৃতি আঁকড়ে ধরে রেখেছে। কুকুরটার কোমরে মোটা লম্বা সুতো বাধা। স্বচ্ছ, প্লাস্টিকের সুতো।
এত সহজ! বলল কিশোর। পানিতে নামারও দরকার হয়নি চোরের। সুতোয় ধরে আস্তে করে পানিতে ছেড়ে দিয়েছে মূর্তিটা, ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে গভীর পানিতে চলে গেছে ওটা। হাত থেকে সুতো ছেড়ে দিয়েছে চোর। স্বচ্ছ সুতো, পানির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেছে। কুকুরটার চোখ আর কশের ফেনা সোনালি, তলার সোনালি মোজাইকের সঙ্গে মিলে গেছে।
বুদ্ধি আছে চোর-ব্যাটার! স্বীকার করল মিকো।
দিন ওটা। অলিভারের দিকে হাত বাড়াল কিশোর।
দেব!
হ্যাঁ। আবার পুলের তলায় রেখে দেব।
কেন!
কারণ, আজ রাতে এটা নিতে আসবে চোর। টেলিভিশন মনিটর অন করে দেব। ঘরে বসেই দেখতে পাব চোরকে।
বুঝেছি, মূর্তিটা ফিরিয়ে দিতে দ্বিধা করছেন অলিভার।
দিয়ে দাও, ফ্র্যাঙ্ক, বলল মিকো।
কিন্তু-কিন্তু মূর্তিটার ক্ষতি হতে পারে!–ভেঙেটেঙে ফেলতে পারে—
ভাঙবে না। ও ব্যাপারে হুশিয়ার থাকবে চোর। ভাঙা মূর্তি বিকোবে না।
ইচ্ছের বিরুদ্ধে মূর্তিটা আবার কিশোরের হাতে তুলে দিলেন অলিভার।
ডুব দিয়ে আবার আগের জায়গায় জিনিসটা রেখে এল কিশোর। ঠাণ্ডায়। কাঁপতে কাঁপতে পানি থেকে উঠে এল। একটা তোয়ালে আর কিছু ন্যাকড়া দরকার। পুলের ধারে এত পানি দেখলে সন্দেহ করে বসবে চোর। পানিতে নেমেছি, অনুমান করে ফেলবে। তাছাড়া চত্বরে ভেজা ছাপ থাকাও উচিত না।
প্রায় ছুটে চলে গেল মিকো। মিনিটখানেক পরেই অলিভারের ঘর থেকে একটা তোয়ালে আর কিছু ছেঁড়া কাপড় নিয়ে এল। তোয়ালেটা কিশোরের হাতে তুলে দিয়ে নিজে পুলের কিনারে ঝরে পড়া পানি পরিষ্কার করতে লেগে গেল।
দ্রুতহাতে গা মুছতে লাগল কিশোর।
সামনের গেট থেকে ছুটে এল মুসা। এনড্রু আসছে!
রবিনকে ডাকো! মিকোর দিকে চেয়ে বলল কিশোর, আপনারা দুজন ওপরে চলে যান! তাড়াতাড়ি ভেজা পায়ের তলা মুছে ফেলতে লাগল সে।
সবার শেষে অলিভারের বসার ঘরে ঢুকল কিশোর। অন্য চারজন আগেই ঢুকে পড়েছে। দরজা বন্ধ করে দিল মিকো। টেলিভিশনের সুইচ অন করল কিশোর।
গেটে দেখা দিল বেড়াল-মানব। চতুর দিয়ে হেঁটে চলল নিজের ফ্ল্যাটের দিকে।
পুলের দিকে তাকালও না! বিড়বিড় করল কিশোর। ভেজা প্যান্ট খুলে ফেলে তোয়ালে জড়িয়ে নিয়েছে কোমরে।
কেন? রবিন শুকনো একটা শার্ট এনে দিল বন্ধুকে। তাকাল না কেন?
মনে হয় গেট থেকেই খেয়াল করেছে, পুলের পানিতে ঢেউ। বোঝাই যায়, কেউ নেমেছিল। কিনারের পানিও পুরোপুরি মুছে ফেলা যায়নি।
ও চোর নয় তাহলে! বলল মুসা।
হয় চোর নয়, কিংবা সন্দেহ করে ফেলেছে, পুলে নেমেছিল কেউ। মূর্তিটা পাওয়া গেছে। আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে তার ওপর। তা যদি হয়ে থাকে, অসম্ভব ধূর্ত সে!—দেখা যাক, কি হয়!
একটা দুটো করে বেড়াল ঢুকতে শুরু করল চত্বরে। এনড্রুর ঘরের বারান্দায় জমায়েত হল কয়েক ডজন। অর্ধচন্দ্রকারে বসে পড়ল। একগাদা প্লেট হাতে বেরিয়ে এল এনড্রু। একটা করে প্লেট রাখল প্রতিটা বেড়ালের সামনে। আবার ঘরে ঢুকল। বড় একটা পাত্রে করে খাবার নিয়ে বেরোল। প্লেট ভরে খাবার দিল। বেড়ালগুলোকে।
জানোয়ারগুলো খাচ্ছে, আর সামনে বসে দেখছে এনড্রু। কথা বলছে ওগুলোর সঙ্গে। আশ্চর্য শৃঙ্খলা! একে অন্যের সঙ্গে মারামারি করল না বেড়ালগুলো, কামড়াকামড়ি খামচাখামচি কিছুই করল না। শান্তভাবে যার যার প্লেটের খাবার শেষ করে চলে গেল একে একে।
প্লেটগুলো নিয়ে আবার ঘরে ঢুকে গেল এনড্রু। খানিক পরেই দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে চলে গেল সে-ও।
টেলিভিশনের পর্দায় একনাগাড়ে চোখ রাখল তিন গোয়েন্দা। এগারোটার সময় যথারীতি আলো নিবে গেল। বেড়াল-মানবের পর আর কেউ ঢোকেনি চত্বরে। বসার ঘরে বসেই ডিনার খেয়ে নিয়েছে ওরা তিনজনে।
জ্যাকেট তুলে নিল মুসা সোফার ওপর থেকে। গায়ে চড়াল। ব্যালকনিতে যাচ্ছি। লুকিয়ে থেকে চোখ রাখব।
আমিও আসছি, উঠে দাঁড়াল কিলোর। টেলিভিশনের সুইচ অফ করে দিল।
আমিও, রবিনও উঠল। আজ রাতে কিছু একটা ঘটবেই। মিস করতে চাই না। বঞ্চিত করতে চাই না চোখকে।
.
১৭.
মাঝরাতে গেট খোলার শব্দ হল। চত্বরে ঢুকল টমি গিলবার্ট। ঘরে চলে গেল। কয়েক মিনিট আলো দেখা গেল তার জানালায়, তারপর নিবে গেল।
ব্যালকনিতে অপেক্ষা করে আছে তিন গোয়েন্দা।
একটা দরজা খুলল, বন্ধ হল, শোনা গেল মৃদু আওয়াজ।
পুলের ওপাশে একটা ছায়া দেখা গেল। কিশোরের হাত খামচে ধরল মুসা।
ধীরে ধীরে পুলের ধারে এসে দাঁড়াল ছায়াটা। আস্তে করে নেমে পড়ল পানিতে। ল্যাম্পপোস্টের আলো পড়েছে পানিতে এক জায়গায়, দেখা গেল ছোট ছোট ঢেউ, সাতরে এগোচ্ছে ছায়াটা।