রবিন আর কিশোর নড়ার আগেই সিঁড়ির মাঝামাঝি নেমে গেছে মুসা। লাফিয়ে এসে নামল চত্বরে। পুলের ধার থেকে আরেকটা চেয়ার তুলে নিয়ে ছুটল।
ঝট করে, বেড়াল-মানবের ঘরের দরজা খুলে গেল। প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এল। এনড্রু।
মিস্টার জ্যাকবস! ভাঙা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
জবাব নেই।
তাড়াতাড়ি চৌকাঠে পড়ে থাকা কাঠের টুকরো সরিয়ে ফেলতে লাগল মুসা। পর্দায় আগুন ধরে গেছে। অনেকখানি পুড়ে গেছে ইতিমধ্যেই। থাবা দিয়ে নেবানর চেষ্টা করল পর্দার আগুন।
এই যে! চিৎকার শোনা গেল কিশোরের। পাশে কুলুঙ্গিতে হুকে ঝোলানো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রটা দেখতে পেয়েছে। ছুটে গিয়ে ওটা খুলে নিয়ে এল সে।
তীক্ষ হিসহিস শব্দ উঠল। যন্ত্রের মুখ থেকে সাদা ফেনামত জিনিস ছুটে গিয়ে পড়তে থাকল জ্বলন্ত পর্দায়। ছ্যাক করে উঠল আগুনের শিখা, নিবে গেল। চেয়ার দিয়ে বাড়ি মেরে জানালার পাল্লার ছিটকিনি ভেঙে ফেলল মুসা, ঝটকা দিয়ে দুপাশে সরে গেল পাল্লাদুটো। চৌকাঠে উঠে বসল টমি, তার পাশেই কিশোর। জানালার ঠিক নিচেই রয়েছে সোফা, জ্বলছে। পাশেই ক্রিসমাস গাছ, ওটাতেও আগুন ধরে গেছে প্রায়। নির্বাপক যন্ত্রের মুখ ঘোরাল কিশোর, একনাগাড়ে ফেনা নিক্ষেপ করে গেল আগুনের ওপর।
মুসা আর রবিনও উঠে বসেছে চৌকাঠে। ধোয়ার জন্য শ্বাস নিতে পারছে না ঠিকমত, চোখ জ্বালা করছে। চেঁচিয়ে ডাকা হল জ্যাকবসের নাম ধরে, কিন্তু কোন। সাড়া এল না।
লাফিয়ে ঘরের মেঝেতে নেমে পড়ল কিশোর আর মুসা। ঝুঁকে চোখ বাঁচানর চেষ্টা করতে করতে এগোল ধোয়ার ভিতর দিয়ে।
বসার ঘর আর শোবার ঘরের দরজার মাঝামাঝি পাওয়া গেল জ্যাকসকে। উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে।
জলদি বের করে নিয়ে যেতে হবে ওকে! ধোয়া ঢুকে যাচ্ছে নাক-মুখ দিয়ে, কেশে উঠল মুসা। নিচু হয়ে বাহু ধরে টেনে চিত করল জ্যাকসকে। জোরে চড় লাগাল দুই গালে।
নড়লও না জ্যাকবস।
এখানে হবে না! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। বের করে নিয়ে যেতে হবে!
দুদিক থেকে দুহাত ধরে টেনে-হিঁচড়ে জ্যাকবসকে নিয়ে চলল দুজনে। ততক্ষণে নেমে পড়েছে রবিন আর টমি। একজন ছুটে গেল দরজা খুলতে, আরেকজন সাহায্য করতে এল মুসা আর কিশোরকে।
জ্যাকবসের পায়ের দিকে তুলে ধরল রবিন। তিনজনে মিলে বয়ে নিয়ে চলল দরজার দিকে।
কাশছে টমি। খুলে ফেলল দরজা।
দম বন্ধ হয়ে আসছে তিন গোয়েন্দার। ভারি দেহটাকে বয়ে নিয়ে কোনমতে এসে পৌঁছুল দরজায়। হাত লাগাল টমি। জ্যাকবসকে নিয়ে আসা হল পুলের ধারে। চিত করে শুইয়ে দেয়া হল। জ্যাকবসের মুখে এসে পড়ছে রোদ। ফেকাসে চেহারা, রক্ত নেই যেন মুখে।
ঈশ্বর! বিড়বিড় করলেন অলিভার।
স্থির দৃষ্টিতে জ্যাকবসের মুখের দিকে চেয়ে আছে এনড্রু। ও কি..ও কি…।
উবু হয়ে বসে লোকটার বুকে কান পেতেছে মুসা। সোজা হয়ে বলল, না, বেঁচেই আছে।
পৌঁছে গেল দমকল বাহিনী। অক্সিজেন আর অ্যামবুলেন্স নিয়ে এসেছে। এখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে জ্যাকবসের ঘর থেকে। সেদিকে ছুটে গেল কয়েকজন ফায়ারম্যান।
ছুটে এসে চত্বরে ঢুকল দমকল বাহিনীর এক ক্যাপ্টেন। সোজা ছুটে গেল জ্যাকবসের ঘরের দিকে।
অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে দুজন ফায়ারম্যান এসে বসল জ্যাকবসের দুপাশে। নাকে মুখে চেপে ধরল মাস্ক। ধীরে ধীরে চোখ মেলল স্টকব্রোকার। মিটমিট করল। ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে গলার ভেতর থেকে। দুর্বল একটা হাত বাড়িয়ে ঠেলে মাস্কটা নাকের ওপর থেকে সরিয়ে দিল সে।
ভয় নেই, মিস্টার, বলল একজন ফায়ারম্যান। খানিকটা ধোয়া ঢুকে গিয়েছিল ফুসফুসে, আর কিছু না।
উঠে বসার চেষ্টা করল জ্যাকবস।
না না, উঠবেন না, বাধা দিল আরেক ফায়ারম্যান। ইমার্জেন্সীতে নিয়ে যাব আপনাকে।
প্রতিবাদ করবে মনে হল, কিন্তু শেষে কি মনে করে করল না জ্যাকবস। শুয়ে পড়ল আবার পাথরের চত্বরে।
জর্জ, স্ট্রেচারটা নিয়ে এস, সঙ্গীকে বলল এক ফায়ারম্যান।
স্ট্রেচার এল। তাতে তুলে নেয়া হল জ্যাকসকে। শান্ত রইল সে। কোনরকম বাধা দিল না। ধূসর একটা কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়া হল তার দেহ। স্ট্রেচার তুলে। নিল দুজন ফায়ারম্যান।
ওর সঙ্গে কারও যাওয়া দরকার, বলল এনড্রু।
আমার ভাগ্নে, দুর্বল গলায় বলল জ্যাকবস। আমার ভাগ্নেকে একটা খবর দেবেন। ও শুনলেই চলে আসবে।
অ্যামবুলেন্সে তোলা হল জ্যাকসকে। সাইরেন বাজিয়ে চলে গেল গাড়ি।
জ্যাকবসের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন। সেই পুরানো কাহিনী। আধপোেড়া একটা সিগারেটের টুকরো ধরে আছে দুআঙুলে, দেখাল। সিগারেট জ্বালিয়ে রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। কোনভাবে সোফায় পড়েছে টুকরোটা, আগুন ধরে গেছে পর্দায়…
কপাল ভাল ওর, বলে উঠল টমি। এখনও খালি পায়েই রয়েছে। চেহারা ফেকাসে। সময়মত দেখতে পেয়েছিলাম…
হ্যাঁ, সত্যিই ভাল, মাথা ঝোঁকাল ক্যাপ্টেন। আরেকটু হলেই আগুন ধরে যেত ক্রিসমাস গাছটায়। সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ত আগুন।
সিগারেট জ্বালিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল? বিশ্বাস করতে পারছে না যেন কিশোর।
অনেকেই এ-কাণ্ড করে, খোকা, বলল ক্যাপ্টেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কিন্তু একটা গামলার সমান অ্যাশট্রে আছে ওর, ক্যাপ্টেনের কথা মানতে পারছে না গোয়েন্দাপ্রধান। ওতে সিগারেট কেন, জ্বলন্ত কয়লার টুকরো রেখে দিলেও ভয় নেই। সিগারেটটা অ্যাশট্রের বাইরে পড়ল কি করে?