হবে কিনা! কিশোরের কথার প্রতিধ্বনি করলেন যেন অলিভার। হতেই হবে। মানে, সাহায্য করতেই হবে আমাকে। এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। হঠাৎ কেঁপে উঠল তার গলা, তীক্ষ্ণ হয়ে এল। এখানে যা ঘটছে, আর সওয়া যাচ্ছে না!
চুপ করলেন অলিভার। উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। শান্ত করার চেষ্টা করছেন। নিজেকে। তোমরা তিন গোয়েন্দা, না? এটা তোমাদের কার্ড? ওয়ালেট থেকে একটা কার্ড বের করে বাড়িয়ে ধরলেন। তাতে লেখা:
তিন গোয়েন্দা
প্রধান: কিশোর পাশা
সহকারী: মুসা আমান
নথিরক্ষক ও গবেষকঃ রবিন মিলফোর্ড
কার্ডটার দিকে একবার চেয়েই মাখা ঝোকাল কিশোর।
ডেভিস দিয়েছে আমাকে কার্ডটা, বললেন অলিভার। চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফার। আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু সে। বলেছে, তোমরা গোয়েন্দা। বিশেষ করে, অদ্ভুত রহস্যের প্রতি তোমাদের আকর্ষণ নাকি বেশি?
ঠিক, স্বীকার করল কিশোর। প্রশ্নবোধকগুলো সেজন্যেই বসিয়েছি। যতরকম আজব, উদ্ভট, অস্বাভাবিক রহস্য ভেদ করতে আগ্রহী আমরা। কয়েকটা রহস্যের সমাধানও করেছি। তো, আপনার অসুবিধেটা কি? না শুনে বলতে পারছি না, সাহায্য করতে পারব কিনা। তবে চেষ্টা অবশ্যই করব। ইতিমধ্যেই আপনার সম্পর্কে কিছু কিছু খোঁজখবর করেছি। আপনি কে, কি, জানা হয়ে গেছে আমাদের।
কি? প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন বৃদ্ধ। আমার ব্যাপারে খোঁজখবর করেছ?
নিশ্চয়। মক্কেলের ব্যাপারে খোঁজ নেব না? আপনি কি বলেন? পাল্টা প্রশ্ন। করে বসল কিশোর।
আড়ালে থাকতেই পছন্দ করি আমি, বললেন বৃদ্ধ। লোকের সঙ্গে বেশি মেলামেশা ভাল লাগে না।
পুরোপুরি আড়ালে কেউই থাকতে পারে না রবিনকে দেখিয়ে বলল কিশোর। কাগজপত্র ঘেঁটে লোকের পরিচয় বের কব্রার ব্যাপারে ওর তুলনা নেই। রবিন, মিস্টার অলিভারকে বল কি কি জেনেছ।
হাসল রবিন। লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারে বটে কিশোর। মনে মনে বন্ধুর প্রতি আরেকবার শ্রদ্ধা জানাল গবেষক। পকেট থেকে ছোট একটা নোটবই বের করে খুলল। লস অ্যাঞ্জেলেসে জন্য আপনার, মিস্টার অলিভার বয়স সত্তর চলছে। আপনার বাবা, মিস্টার হারল্ড অলিভার, বিরাট বড়লোক ছিলেন। অনেক সম্পত্তি রেখে গেছেন, আপনার নামে। বাপের সম্পত্তি নষ্ট করেননি আপনি, বহাল রেখেছেন ঠিকমতই। চিরকুমার রয়ে গেছেন। এমণে প্রচণ্ড নেশা, শিল্পের প্রতি বেজায় ঝোঁক। মাঝে মাঝেই বিভিন্ন মিউজিয়ম আর দরিদ্র শিল্পীদের দান-খয়রাত করেন। শিল্পের সমঝদার বলে আখ্যায়িত করেছে আপনাকে খবরের কাগজগুলো।
বড় বেশি বাড়িয়ে লেখে ব্যাটারা, গজগজ করলেন অলিভার। সেজন্যেই খবরের কাগজ নিয়ে মাথা ঘামাই না আমি।
কিন্তু ওরা আপনাকে নিয়ে ঘামায়, বলল কিশোর। তবে, খুব বেশি বাড়িয়ে লিখেছে বলে তো মনে হয় না। ঘরের বিভিন্ন জায়গায় সাজিয়ে রাখা শিল্পকর্মগুলো দেখাল সে।
বেশ বড়সড় একটা শো-কেস রয়েছে ঘরের এক প্রান্তে। তাতে নানারকম দামি সংগ্রহ। তাছাড়া দেয়ালে ঝুলছে চমৎকার সব চিত্র, টেবিলে চীনামাটির তৈরি অসংখ্য মূর্তি। এখানে ওখানে কায়দা করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বেশ কয়েকটা প্রদীপ, নিশ্চয় ইংল্যাণ্ডের মূরদের কোন প্রাসাদ থেকে এসেছে।
ওসব কথা থাক, বললেন অলিভার। সুন্দর জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ। থাকেই, এর জন্যে অতিমানব হওয়ার দরকার পড়ে না। কিন্তু এখানে যা ঘটছে, ওসবের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।
– কি ঘটছে? জানতে চাইল কিশোর।
কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকালেন মিস্টার অলিভার। পাশের ঘরে তাঁর কথা কেউ শুনতে পাচ্ছে, আশঙ্কা করছেন যেন। ফিসফিস করে বললেন, ভূতের চোখ পড়েছে আমার ওপর!
একদৃষ্টিতে বৃদ্ধের দিকে চেয়ে আছে তিন গোয়েন্দা।
বিশ্বাস করতে পারছ না? আবার বললেন অলিভার, কিন্তু সত্যি বলছি, ভূতের চোখ পড়েছে। আমি বাইরে গেলেই কেউ একজন এসে ঢোকে এখানে। জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে। যেটা যেখানে রেখে যাই, ফিরে এসে আর সেখানে পাই না। একবার দেখলাম, ডেস্কের ড্রয়ার খোলা চিঠিপত্র অগোছাল। অনেক বড় অ্যাপার্টমেন্ট হাউস আপনার, বলল কিশোর। ম্যানেজার নেই? নিশ্চয় মাস্টার কী রয়েছে তার কাছে?
নাক কোচকালেন অলিভার। ওই নাকা বুড়িটাই আমার ম্যানেজার। তবে চাবি নেই ওর কাছে। তাছাড়া আমার ঘরে বিশেষ তালা লাগিয়েছি। কোন চাকর-বাকর নেই। জানালা দিয়ে ঢোকে না কেউ, আমি শিওর। জানালা খোলা রেখে কখনও বেরোই না। আর খোলা রাখলেও ঢোকা সহজ না। রাস্তা থেকে বিশ ফুট ওপরে। রয়েছে ওগুলো। উঠতে হলে উঁচু মই দরকার। এবং সেটা করতে গেলে লোকের চোখে পড়ে যাবেই সে।
হয়ত বাড়তি চাবি আছে কারও কাছে, বলল মুসা। আপনি বেরিয়ে গেলেই তালা খুলে—
হাত তুললেন অলিভার। না না, সেটা নয়। আগে শোন সবটা। বেরিয়ে গেলেই যে শুধু ঢোকে, তা নয়। পুরো ঘরে চোখ বোলালেন তিনি, নিশ্চিত হয়ে নিলেন ছেলেরা ছাড়া আর কেউ নেই। কখনও-কখনও আমি ঘরে থাকলেও সে ঢোকে। আমি—আমি—দেখেছি।—ও আসে, যায়, দরজা খোলার দরকারই পড়ে
কেমন দেখতে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
তালুতে তালু ডলছেন অলিভার। অস্বস্তি বোধ করছেন, বোঝা যাচ্ছে। পুলিশকে বললে তারাও এ প্রশ্নই করত, মুখ তুললেন। তবে, আমার জবাব। বিশ্বাস করত না তারা। সেজন্যেই তাদেরকে ডাকিনি, তোমাদেরকে ডেকেছি। আমি যাকে দেখেছি—সে মানুষ নয়, মানুষের ছায়া বললেই ঠিক হবে। বসে হয়ত কখনও পড়ছি, হঠাৎ অনুভব করি তার অস্তিত্ব। চোখ তুলে তাকালেই দেখতে পাই। একবার দেখেছি হলঘরে। লম্বা, রোগা টিঙটিঙে। কথা বললাম। কোন জবাব দিল না। শেষে চেঁচিয়ে উঠলাম। ফিরেও তাকাল না। সোজা ঢুকে পড়ল আমার কাজের ঘরে। পেছন পেছন গেলাম। নেই। অদৃশ্য হয়ে গেছে।