অন্ধকারে কোথায় বা কাহার কণ্ঠস্বর বোঝা গেল না। কিন্তু নারীকণ্ঠের কাতর ক্রন্দন ধ্বনিয়া উঠিল, ওগো, খোকা পড়ে গেইছে বুক থেকে। খোকা রে!
তারিণী বলিল, এইখানেই থাকবি সুখী, ডাকলে সাড়া দিস।
সে অন্ধকারে মিলাইয়া গেল। শুধু তাহার কণ্ঠস্বর শোনা যাইতেছিল, কে? কোথা? কার ছেলে পড়ে গেল, সাড়া দাও, ওই!
ওদিক হইতে সাড়া আসিল, এই যে।
তারিণী আবার হাঁকিল, ওই!
কিছুক্ষণ ধরিয়া কণ্ঠস্বরের সঙ্কেতের আদান-প্রদান চলিয়া সে শব্দ বন্ধ হইয়া গেল। তাহার পরই তারিণী ডাকিল, সুখী!
সুখী সাড়া দিল, অ্যাঁ?
শব্দ লক্ষ্য করিয়া তারিণী ডাকিল, আমার কোমর ধর সুখী,গতিক ভাল নয়।
সুখী আর প্রতিবাদ করিল না। তারিণীর কোমরের কাপড় ধরিয়া চলিল, কার ছেলে বটে? পেলে?
তারিণী বলিল, পেয়েছি, ভূপতে ভল্লার ছেলে।
সন্তর্পণে জল ভাঙিয়া তাহারা চলিয়াছিল। জল ক্রমশ যেন বাড়িয়া চলিয়াছে। তারিণী বলিল, আমার পিঠে চাপ সুখী। কিন্তু এ কোন দিকে এলাম সুখী, ই–ই–
কথা শেষ হইবার পূর্বেই অথই জলে দুইজনে ডুবিয়া গেল। পরক্ষণেই কিন্তু ভাসিয়া উঠিয়া বলিল, লদীতেই যে পড়লাম সুখী। পিঠ ছেড়ে আমার কোমরের কাপড় ধরে ভেসে থাক।
স্রোতের টানে তখন তাহারা ভাসিয়া চলিয়াছে। গাঢ় গভীর অন্ধকার, কানের পাশ দিয়া বাতাস চলিয়াছে—হু-হু শব্দে, তাহারই সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে ময়ূরাক্ষীর বানের হুড়মুড় শব্দ। চোখে মুখে বৃষ্টির ছাঁট আসিয়া বিধিতেছিল তীরের মত কুটার মত তাহারা চলিয়াছে কতক্ষণ, তাহার অনুমান হয় না, মনে হয় কত দিন কত মাস তাহার হিসাব নাই—নিকাশ নাই। শরীরও ক্রমশ যেন আড়ষ্ট হইয়া আসিতেছিল। মাঝে মাঝে ময়ূরাক্ষীর তরঙ্গ শ্বাসরোধ করিয়া দেয়। কিন্তু সুখীর হাতের মুঠি কেমন হইয়া আসে যে! সে যে ক্রমশ ভারী হইয়া উঠিতেছে। তারিণী ডাকিল, সুখী— সুখী?
উন্মত্ততার মত সুখী উত্তর দিল, হ্যাঁ?
ভয় কি তোর, আমি—
পরমুহূর্তে তারিণী অনুভব করিল, অতল জলের তলে ঘুরিতে ঘুরিতে তাহারা ডুবিয়া চলিয়াছে। ঘূর্ণিতে পড়িয়াছে তাহারা। সমস্ত শক্তি পুঞ্জিত করিয়া সে জল ঠেলিবার চেষ্টা করিল। কিছুক্ষণেই মনে হইল, তাহারা জলের উপরে উঠিয়াছে। কিন্তু সম্মুখের বিপদ তারিণী জানে, এইখানে আবার ডুবিতে হইবে। সে পাশ কাটাইবার চেষ্টা করিল। কিন্তু এ কি, সুখী যে নাগপাশের মত জড়াইয়া ধরিতেছে! সে ডাকিল, সুখী সুখী! ঘুরিতে ঘুরিতে আবার জলতলে চলিয়াছে। সুখীর কঠিন বন্ধনে তারিণীর দেহও যেন অসাড় হইয়া আসিতেছে। বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড যেন ফাটিয়া গেল। তারিণী সুখীর দৃঢ় বন্ধন শিথিল করিবার চেষ্টা করি কিন্তু সে আরও জোরে জড়াইয়া ধরিল। বাতাস—বাতাস! যন্ত্রণায় তারিণী জল খামচাইয়া ধরিতে লাগিল। পরমুহূর্তে হাত পড়িল সুখীর গলায় দুই হাতে প্রবল আক্রোশে সে সুখীর গলা পেষণ করিয়া ধরিল। সে কি তাহার উন্মত্ত ভীষণ আক্রোশ! হাতের মুঠিতেই তাহার সমস্ত শক্তি পুঞ্জিত হইয়া উঠিয়াছে। যে বিপুল বিরাট পাথরের মত টানে তাহাকে অতলে টানিয়া লইয়াছিল, সেটা খসিয়া গেলা সঙ্গে সঙ্গে জলের উপরে ভাসিয়া উঠিল। আঃ, আঃ—বুক ভরিয়া বাতাস টানিয়া লইয়া আকুলভাবে সে কামনা করিল, আলো ও মাটি।