তারিণী চাহিয়া ছিল অন্যদিকে, সে বলিল, মেঘ আসতে কতক্ষণ? ওই দেখ, কাকে কুটো তুলছে–বাসার ভাঙা-ফুটো সারবো আজ এইখানেই থাক সুখী, আর যাব না দেখি মেঘের গতিক।
খেয়া মাঝির পর্যবেক্ষণ ভুল হয় নাই অপরাহ্নের দিকে আকাশ মেঘে ছাইয়া গেল, পশ্চিমের বাতাস ক্রমশ প্রবল হইয়া উঠিল।
তারিণী বলিল, ওঠ সুখী, ফিরব।
সুখী বলিল, এই অবেলায়?
তারিণী বলিল, ভয় কি তোর, আমি সঙ্গে রইছি। লে, মাথালি তু মাথায় দো টিপিটিপি জল ভারি খারাপা
সুখী বলিল, আর তুমি, তোমার শরীল বুঝি পাথরের?
তারিণী হাসিয়া বলিল, ওরে, ই আমার জলের শরীল, রোদে টান ধরে জল পেলেই ফোলে। চল, দে পুঁটলি আমাকে দে।
ধীরে ধীরে বাদল বাড়িতেছিল। উতলা বাতাসের সঙ্গে অল্প কিছুক্ষণ রিমিঝিমি বৃষ্টি হইয়া যায়। তারপর থামে। কিছুক্ষণ পর আবার বাতাস প্রবল হয়, সঙ্গে সঙ্গে নামে বৃষ্টি।
যে পথ গিয়াছিল তাহারা তিন দিনে, ফিরিবার সময় সেই পথ অতিক্রম করিল দুই দিনে। সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরিয়াই তারিণী বলিল, দাঁড়া, লদীর ঘাট দেখে আসি। ফিরিয়া আসিয়া পুলকিত চিত্তে তারিণী বলিল, লদী কানায় কানায়, সুখী।
প্রভাতে উঠিয়াই তারিণী ঘাটে যাইবার জন্য সাজিল। আকাশ তখন দুরন্ত দুর্যোগে আচ্ছন্ন, ঝড়ের মত বাতাস, সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝম করিয়া বৃষ্টি।
দ্বিপ্রহরে তারিণী ফিরিয়া আসিয়া বলিল, কামার বাড়ি চললাম আমি।
সুখী ব্যস্তভাবে বলিল, খেয়ে যাও কিছু।
চিন্তিত মুখে ব্যস্ত তারিণী বলিল, না, ডোঙার একটা বড় গজাল খুলে গেইচে। সে না হলে— উহু, অল্প বান হলে না হয় হত, লদী একেবারে পাথর হয়ে উঠেছে দেখসে আয়।
সুখীকে না দেখাইয়া ছাড়িল না। পালদের পুকুরের উঁচু পাড়ের উপর দাঁড়াইয়া সুখী দেখিল, ময়ুরাক্ষীর পরিপূর্ণ রূপা বিস্তৃত যেন পারাপারহীন। রাঙা জলের মাথায় রাশি রাশি পুঞ্জিত ফেনা ভাসা-ফুলের মত দ্রুতবেগে ছুটিয়া চলিয়াছে। তারিণী বলিল, ডাক শুনছিস—সোঁ-সোঁ? বান আরও বাড়বে, তু বাড়ি যা, আমি চললাম। লইলে কাল আর ডাক পার করতে পারব না।
সুখী অসন্তুষ্ট চিত্তে বলিল, এই জল ঝড়—
তারিণী সে কথা কানেই তুলিল না। দুরন্ত দুর্যোগের মধ্যেই সে বাহির হইয়া গেল।
যখন সে ফিরিল, তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। দ্রুতপদে সে আসিতেছিল কি একটা ‘ডুগডুগ’ শব্দ শোনা যায় না? হাঁ, ডুগডুগিই বটে। এ শব্দের অর্থ তো সে জানে, আসন্ন বিপদ। নদীর ধারে গ্রামে গ্রামে এই ডুগডুগি যখন বাজে, তখন বন্যার ভয় আসন্ন বুঝিতে হয়।
তারিণীর গ্রামের ও-পাশে ময়ূরাক্ষী, এ-পাশে ছোট একটা কাঁতার অর্থাৎ ছোট্ট শাখা নদী একটা বাঁশের পুল দিয়া গ্রামে প্রবেশের পথ তারিণী সড়ক পথ ধরিয়া আসিয়াও বাঁশের পুল খুঁজিয়া পাইল না। তবে পথ ভুল হইল নাকি? অন্ধকারের মধ্যে অনেকক্ষণ ঠাহর করিল, সে পুলের মুখ এখনও অন্তত এক শত বিঘা জমির পরে ঠিক বন্যার জলের ধারেই সে দাঁড়াইয়া ছিল, আঙুলের ডগায় ছিল জলের সীমা। দেখিতে দেখিতে গোড়ালি পর্যন্ত জলে ডুবিয়া গেল। সে
কান পাতিয়া রহিল, কিন্তু বাতাস ও জলের শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যায় না, আর একটা গর্জনের মত গোঁ-গোঁ শব্দ। দেখিতে দেখিতে সর্বাঙ্গ তাহার পোকায় ছাইয়া গেল। লাফ দিয়া মাটির পোকা পালাইয়া যাইতে চাহিতেছে।
তারিণী জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িল।
ক্ষিপ্রগতিতে মাঠের জল অতিক্রম করিয়া গ্রামে প্রবেশ করিয়া সে চমকিয়া উঠিল। গ্রামের মধ্যেও বন্যা প্রবেশ করিয়াছে। এক কোমর জলে পথঘাট ঘরদ্বার সব ভরিয়া গিয়াছে। পথের উপর দাঁড়াইয়া গ্রামের নরনারী আর্ত চীষ্কার করিয়া এ উহাকে ডাকিতেছে। গরু ছাগল ভেড়া কুকুরের সে কি ভয়ার্ত চিৎকার! কিন্তু সে সমস্ত শব্দ আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছিল ময়ূরাক্ষীর গর্জন, বাতাসের অট্টহাস্য আর বর্ষণের শব্দ লুণ্ঠনকারী ডাকাতের দল অট্টহাস্য ও চিৎকারে যেমন করিয়া ভয়ার্ত গৃহস্থের ক্রন্দন ঢাকিয়া দেয়, ঠিক তেমনই ভাবে
গভীর অন্ধকারে পথও বেশ চেনা যায় না।
জলের মধ্যে কি একটা বস্তুর উপর তারিণীর পা পড়িল, জীব বলিয়াই বোধ হয়। হেঁট হইয়া তারিণী সেটাকে তুলিয়া দেখিল, ছাগলের ছানা একটা, শেষ হইয়া গিয়াছে। সেটাকে ফেলিয়া দিয়া কোনরূপে সে বাড়ির দরজায় আসিয়া ডাকিল, সুখী-সুখী!
ঘরের মধ্য হইতে সাড়া আসিল—অপরিমেয় আশ্বস্ত কণ্ঠস্বরে সুখী সাড়া দিল, এই যে, ঘরে আমি
ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তারিণী দেখিল, ঘরের উঠানে এক কোমর জল। দাওয়ার উপর এক-হাঁটু জলে চালের বাঁশ ধরিয়া সুখী দাঁড়াইয়া আছে।
তারিণী তাহার হাত টানিয়া ধরিয়া বলিল, বেরিয়ে আয়, এখন কি ঘরে থাকে, ঘর চাপা পড়ে মরবি যে!
সুখী বলিল, তোমার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি। কোথা খুঁজে বেড়াতে বল দেখি?
পথে নামিয়া তারিণী দাঁড়াইল, বলিল, কি করি বল দেখি সুখী?
সুখী বলিল, এইখানেই দাঁড়াও। সবার যা দশা হবে, আমাদেরও তাই হবে।
তারিণী বলিল, বান যদি আরও বাড়ে, সুখী? গোঁ-গোঁ ডাক শুনছিস না? সুখী বলিল, আর কি বান বাড়ে গো? আর বান বাড়লে দেশের কি থাকবে? ছিষ্টি কি আর লষ্ট করবে ভগবান?
তারিণী এ আশ্বাস গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না।
একটা হুড়মুড় শব্দের সঙ্গে বন্যার জল ছটকাইয়া দুলিয়া উঠিল। তারিণী বলিল, আমাদেরই ঘর পড়ল সুখী। চল, আর লয়, জল কোমরের ওপর উঠল, তোর তো এক ছাতি হয়েছে তা হলো।