কালাচাঁদ একান্ত অপ্রতিভের মত তারিণীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কালাচাঁদের সে দৃষ্টি তারিণী সহ্য করিতে পারিল না, সে অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া বসিল। কিছুক্ষণ পর অকস্মাৎ যেন সচেতনের মত নড়িয়া-চড়িয়া বসিয়া সে বলিয়া উঠিল, বাতাস ঘুরেছে লয় কেলে, পচি বইছে না? বলিতে বলিতে সে লাফ দিয়া ডাঙ্গায় উঠিয়া শুষ্ক বালি একমুঠা ঝুরঝুর করিয়া মাটিতে ফেলিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু বায়ুপ্রবাহ অতি ক্ষীণ, পশ্চিমের কি না ঠিক বুঝা গেল না। তবুও সে বলিল, হুঁ, পচি থেকে ঠেল হইছে—একটুকুন আয় কেলে, মদ খাব, আয়। দু আনা পয়সা আছে আজ। বার করে নিয়েছি আজ সুখীর খুঁট খুলে
সস্নেহ নিমন্ত্রণে কালাচাঁদ খুশি হইয়া উঠিয়াছিল। সে তারিণীর সঙ্গ ধরিয়া বলিল, তোমার বউয়ের হাতে টাকা আছে দাদা। বাড়ি গেলে তোমার ভাত ঠিক পাবেই। মলাম আমরাই।
তারিণী বলিল, সুখী বড় ভাল রে কেলে, বড় ভাল। উ না থাকলে আমার হাড়ির ললাট ডোমের দুগগতি হয় ভাই। সেবার সেই ভাইয়ের বিয়েতে–
বাধা দিয়া কালাচাঁদ বলিল, দাঁড়াও দাদা, একটা তাল পড়ে রইছে, কুড়িয়ে লি।
সে ছুটিয়া পাশের মাঠে নামিয়া পড়িল।
একদল লোক গ্রামের ধারে গাছতলায় বসিয়াছিল, তারিণী প্রশ্ন করিল, কোথা যাবা হে তোমরা, বাড়ি কোথা?
একজন উত্তর দিল, বীরচন্দ্রপুর বাড়ি ভাই আমাদের, খাটতে যাব আমরা বদ্ধমান।
কালাচাঁদ প্রশ্ন করিল, বদ্ধমানে কি জল হইছে নাকি?
জল হয় নাই, ক্যানেলে আছে কিনা।
দেখিতে দেখিতে দেশে হাহাকার পড়িয়া গেল। দুর্ভিক্ষ যেন দেশের মাটির তলেই আত্মগোপন করিয়া ছিল, মাটির ফাটলের মধ্য দিয়া পথ পাইয়া সে ভয়াল মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করিয়া বসিল। গৃহস্থ আপনার ভাণ্ডার বন্ধ করিলা জনমজুরের মধ্যে উপবাস শুরু হইলা দলে দলে লোক দেশ ছাড়িতে আরম্ভ করিল।
সেদিন সকালে উঠিয়া তারিণী ঘাটে আসিয়া দেখিল কালাচাঁদ আসে নাই। প্রহর গড়াইয়া গেল, কালাচাঁদ তবুও আসিল না। তারিণী উঠিয়া কালাচাঁদের বাড়ি গিয়া ডাকিল, কেলে!
কেহ উত্তর দিল না বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিল, ঘরদ্বার শূন্য খাঁ খাঁ করিতেছে, কেহ কোথাও নাই। পাশের বাড়িতে গিয়া দেখিল, সে বাড়িও শূন্য। শুধু সে বাড়িই নয়, কালাচাঁদের পাড়াটাই জনশূন্যা পাশের চাষাপাড়ায় গিয়া শুনিল, কালাচাঁদের পাড়ার সকলেই কাল রাত্রে গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে।
হারু মোড়ল বলিল, বললাম আমি তারিণী, যাস না সব, যাস না। তা শুনলে না, বলে, বড়নোখের গাঁয়ে ভিখ করবা
তারিণীর বুকের ভিতরটা কেমন করিতেছিল সে ওই জনশূন্য পল্লীটার দিকে চাহিয়া শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
হারু আবার বলিল, দেশে বড়নোক কি আছে? সব তলা-ফাঁকা তাদের আবার বড় বেপদা পেটে না খেলেও মুখে কবুল দিতে পারে না। এই তো কি বলে—গাঁয়ের নাম, ওই যে। পলাশডাঙ্গা, পলাশডাঙ্গার ভদ্দরনোক একজন গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। শুধু অভাবে মরেছে।
তারিণী শিহরিয়া উঠিল।
পরদিন ঘাটে এক বীভৎস কাণ্ড। মাঠের পাশেই এক বৃদ্ধার মৃতদেহ পড়িয়া ছিল। কতকটা তার শৃগাল-কুকুরে ছিড়িয়া খাইয়াছে। তারিণী চিনিল, একটি মুচি পরিবারের বৃদ্ধ মাতা এ হতভাগিনী। গত অপরাহ্নে চলচ্ছক্তিহীনা বৃদ্ধার মৃত্যু কামনা বার বার তাহারা করিতেছিল। বৃদ্ধার জন্যই ঘাটের পাশে গত রাত্রে তাহার আশ্রয় লইয়াছিল। রাত্রে ঘুমন্ত বৃদ্ধাকে ফেলিয়া তাহারা পালাইয়াছে।
সে আর সেখানে দাঁড়াইল না। বরাবর বাড়ি আসিয়া সুখীকে বলিল, লে সুখী, খানচারেক কাপড় আর গয়না কটা পেট-আঁচলে বেঁধে লো। আর ই গাঁয়ে থাকব না, শহর দিকে যাবা দিন খাটুনি তো মিলবে।
জিনিসপত্র বাঁধিবার সময় তারিণী দেখিল, হাতের শাঁখা ছাড়া কোন গহনাই সুখীর নাই। তারিণী চমকিয়া উঠিয়া প্রশ্ন করিল, আর?
সুখী ম্লান হাসিয়া বলিল, এতদিন চলল কিসে বল?
তারিণী গ্রাম ছাড়িল।
দিন তিনেক পথ চলিবার পর সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামের প্রান্তে তাহারা রাত্রির জন্য বিশ্রাম লইয়াছিল। গোটা দুই পাকা তাল লইয়া দুইজনে রাত্রির আহার সারিয়া লইতেছিল। তারিণী চট করিয়া উঠিয়া খোলা জায়গায় গিয়া দাঁড়াইল। থাকিতে থাকিতে বলিল, দেখি সুখী গামছাখানা। গামছাখানা লইয়া হাতে ঝুলাইয়া সেটাকে সে লক্ষ্য করিতে আরম্ভ করিল। ভোরবেলায় সুখীর ঘুম ভাঙিয়া গেল, দেখিল, তারিণী ঠায় জাগিয়া বসিয়া আছে। সে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, ঘুমোও নাই তুমি?
হাসিয়া তারিণী বলিল, না, ঘুম এল না।
সুখী তাহাকে তিরস্কার আরম্ভ করিল, ব্যামো-স্যামো হলে কী করব বল দেখি আমি? ই মানুষের বাইরে বেরুনো কেনে বাপু, ছি—ছি–ছি!
তারিণী পুলকিত কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, দেখেছিস, সুখী, দেখেছিস?
সুখী বলিল, আমার মাথামুণ্ডু কি দেখব, বল?
তারিণী বলিল, পিঁপড়েতে ডিম মুখে নিয়ে ওপরের পানে চলল, জল এইবার হবে। সুখী দেখিল, সত্যই লক্ষ লক্ষ পিপীলিকা শ্রেণীবদ্ধ ভাবে প’ড়ো ঘরখানার দেওয়ালের উপর উঠিয়া চলিয়াছে। মুখে তাহাদের সাদা সাদা ডিম।
সুখী বলিল, তোমার যেমন—।
তারিণী বলিল, ওরা ঠিক জানতে পারে, নিচে থাকলে যে জলে বাসা ভেসে যাবে। ইদিকে বাতাস কেমন বইছে, দেখেছিস? ঝাড়া পচি থেকে।
আকাশের দিকে চাহিয়া সুখী বলিল, আকাশ তো ফটফটে—চকচক করছে।