সম্মুখে আমানির বাটি ধরিয়া দিয়া সুখী তারিণীর কাপড়ের খুঁট খুলিতে আরম্ভ করিল, বাহির হইল নথখানি আর তিনটি টাকা।
সুখী প্রশ্ন করিল, আর দু টাকা কই?
তারিণী বলিল, কেলে, ওই কেলে, দিয়ে দিলাম কেলেকে—যা লিয়ে যা।
সুখী এ কথায় কোনও বাদ-প্রতিবাদ করিল না, সে তাহার অভ্যাস নয়। তারিণী আবার বকিতে শুরু করিল, সেবার সেই তোর যখন অসুখ হল, ডাক পার হয় না, পুলিশ সাহেব ঘাটে বসে ভাপাইছে, হুহু বাপ—সেই বকশিশে তোর কানের ফুল যা, তু যা, এখুনি ডাক লদীর পার থেকে—এই উঠে আয় হারামজাদা লদী। উবে আসবে। যা যা।
সুখী বলিল, দাঁড়াও আয়নাটা লিয়ে অসি, লতটা পরি।
তারিণী খুশী হইয়া নীরব হইল। সুখী আনিয়া সম্মুখে রাখিয়া নথ পরিতে বসিল। সে হাঁ করিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল, ভাত খাওয়া তখন বন্ধ হইয়া গিয়াছে। নথ পরা শেষ হইতেই সে উচ্ছিষ্ট হাতেই আলোটা তুলিয়া ধরিয়া বলিল, দেখি দেখি।
সুখীর মুখে পুলকের আবেগ ফুটিয়া উঠিল, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখোনি তাহার রাঙা হইয়া উঠিল।
তারিণী সাবি-ঠাকরুণকে মিথ্যা কথা বলিয়াছিল। সুখী তন্বী, সুখী সুশ্রী, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা সুখীর জন্য তারিণীর সুখের সীমা নাই।
তারিণী মত্ত অবস্থাতে বলিলেও মিথ্যা বলে নাই। ওই ময়ূরাক্ষীর প্রসাদেই তারিণীর অন্নবস্ত্রের অভাব হয় না। দশহরার দিন ময়ূরাক্ষীর পূজাও সে করিয়া থাকে। এবার তেরো শশা বিয়াল্লিশ সালে দশহরার দিন তারিণী নিয়মমত পূজা-অর্চনা করিতেছিল। তাহার পরনে নূতন কাপড়, সুখীর পরনেও নূতন শাড়ি-ঘোষ মহাশয়ের দেওয়া পার্বণী জলহীন ময়ূরাক্ষীর বালুকাময় গর্ভ গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রে ঝিকিমিকি করিতেছিল। তখনও পর্যন্ত বৃষ্টি নামে নাই। ভোগপুরের কেষ্ট দাস নদীর ঘাটে নামিয়া একবার দাঁড়াইল। সমস্ত দেখিয়া একবার আকাশের দিকে চাহিয়া বলিল, ভাল করে পুজো কর তারিণী, জল-টল হোক, বান-টান আসুক, বান না এলে চাষ হবে কি করে?
ময়ূরাক্ষীর পলিতে দেশে সোনা ফলে।
তারিণী হাসিয়া বলিল, তাই বল বাপু। লোকে বলে কি জান দাস, বলে, শালা বানের লেগে পুজো দেয়। এই মায়ের কিপাতেই এ মুলুকের লক্ষ্মী ধর ধর কেলে, ওরে, পাঁঠা পালাল, ধরা
বলির পাঁঠাটা নদীগর্ভে উত্তপ্ত বালুকার উপর আর থাকিতে চাহিতেছিল না।
পূজা-অর্চনা সুশৃঙ্খলেই হইয়া গেল। তারিণী মদ খাইয়া নদীর ঘাটে বসিয়া কালাচাঁদকে বলিতেছিল, হড়হড় কলকলবানলে কেনে তু দশ দিন বাদা।
কালাচাঁদ বলিল, এবার মাইরি তু কিন্তুক ভাসা জিনিস ধরতে পাবি না। এবার কিন্তু আমি ধরব, হ্যাঁ।
তারিণী মত্ত হাসি হাসিয়া বলিল, বড় ঘুরণ-চাকে তিনটি বুটবুটি, বুক—বুক—বুক—বুক, বাস কালাচাঁদ–কালাচাঁদ ফরসা।
কালাচাঁদ অপমানে আগুন হইয়া উঠিল, কি বললি শালা?
তারিণী খাড়া সোজা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, কিন্তু সুখী মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া সব মিটাইয়া দিল। সে বলিল, ছোট বানের সময়ই পাকুছ পর্যন্ত বানে দেওর ধরবে, আর পাকুছ ছাড়ালেই তুমি।
কালাচাঁদ সুখীর পায়ের ধূলা লইয়া কাঁদিয়া বুক ভাসাইয়া দিল, বউ লইলেই বলে কে?
পরদিন হইতে ডোঙা মেরামত আরম্ভ হইল, দুইজনে হাতুড়ি নেয়ান লইয়া সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিশ্রম করিয়া ডোঙাখানাকে প্রায় নূতন করিয়া ফেলিল।
কিন্তু সে ডোঙায় আবার ফাট ধরিল রৌদ্রের টানো। সমস্ত আষাঢ়ের মধ্যে বান হইল না। বান দূরের কথা, নদীর বালি ঢাকিয়া জলও হইল না। বৃষ্টি অতি সামান্য দুই চারি পশলা। সমস্ত দেশটার মধ্যে একটা মৃদু কাতর ক্রন্দন যেন সাড়া দিয়া উঠিল। প্রত্যাসন্ন বিপদের জন্য দেশ যেন মৃদুস্বরে কাঁদিতেছিল। কিংবা হয়তো বহুদূরের যে হাহাকার আসিতেছে, বায়ুস্তরবাহিত তাহারই অগ্রধ্বনি এ তারিণীর দিন আর চলে না। সরকারী কর্মচারীদের বাইসিকল ঘাড়ে করিয়া নদী পার করিয়া দুই-চারটি পয়সা মেলে, তাহাতেই সে মদ খায়। সরকারী কর্মচারীদের এ সময়ে আসা-যাওয়ার হিড়িক পড়িয়া গিয়াছে—তাঁহারা আসেন দেশে সত্যই অভাব আছে কি না তাহারই তদন্তে। আরও কিছু মেলে—সে তাহাদের ফেলিয়া দেওয়া সিগারেটের কুটি।
শ্রাবণের প্রথমেই বন্যা আসিল। তারিণী হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। বন্যার প্রথম দিন বিপুল আনন্দে সে তালগাছের মত উঁচু পাড়ের উপর হইতে ঝাঁপ দিয়া নদীর বুকে পড়িয়া বন্যার জল আরও উচ্ছল ও চঞ্চল করিয়া তুলিল।
কিন্তু তিন দিনের দিন নদীতে আবার হাঁটুজল হইয়া গেলা গাছে বাঁধা ডোঙাটা তরঙ্গাঘাতে মৃদু দোল খাইতেছিল। তাহারই উপর তারিণী ও কালাচাঁদ বসিয়া ছিল—যদি কেহ ভদ্র যাত্রী আসে তাহারই প্রতীক্ষায়, যে হাঁটিয়া পার হইবে না। এ অবস্থায় তাহারা দুইজনে মিলিয়া ডোঙাটা ঠেলিয়া লইয়া যায়।
সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিতেছিল। তারিণী বলিল, ই কি হল বল দেখি কেলে?
চিন্তাকুলভাবে কালাচাঁদ বলিল, তাই তো!
তারিণী আবার বলিল, এমন তো কখনও দেখি নাই! সে
ই পূর্বের মতই কালাচাঁদ উত্তর দিল, তাই তো!
আকাশের দিকে চাহিয়া তারিণী বলিল, আকাশে দেখ কেনে—ফরসা লীলা পচিদিকেও তো ডাকে না!
কালাচাঁদ এবার উত্তর দিল, তাই তো!
ঠাস করিয়া তাহার গালে একটা চড় কসাইয়া দিয়া তারিণী বলিল, তাই তো! তাই তো বলতেই যেন আমি ওকে বলছি। তাই তো! তাই তো!