অন্য তীরের জনতা চীৎকার করিয়া প্রশ্ন করিতেছিল, উঠেছে? উঠেছে?
কালাচাঁদ তখন ডোঙা লইয়া ছুটিয়াছিল।
তারিণীর ভাগ্য ভাল। জলমগ্ন ব্যক্তিটি স্থানীয় বর্ধিষ্ণু ঘরেরই একটি বধূ। ওলকুড়ার ঘাটে ডোঙা ডুবে নাই, দীর্ঘ অবগুণ্ঠনাবৃতা বধূটি ডোঙার কিনারায় ভর দিয়া সরিয়া বসিতে গিয়া এই বিপদ ঘটাইয়া বসিয়াছিল। অবগুণ্ঠনের জন্যই হাতটা লক্ষভ্রষ্ট হইয়া সে টলিয়া জলে পড়িয়া গিয়াছিলা মেয়েটি খানিকটা জল খাইয়াছিল, কিন্তু তেমন বেশী কিছু নয়—অল্প শুশ্রষাতেই তাহার চেতনা ফিরিয়া আসিল।
নিতান্ত কচি মেয়ে–তের চৌদ্দ বৎসরের বেশি বয়স নয় দেখিতে বেশ সুশ্রী, দেহে অলঙ্কার কয়খানা রহিয়াছে—কানে মাকড়ি, নাকে টানা-দেওয়া নখ, হাতে রুলি, গলায় হার। সে তখনও হাঁপাইতেছিল। অল্পক্ষণ পরেই মেয়েটির স্বামী ও শ্বশুর আসিয়া পৌঁছিলেন।
তারিণী প্রণাম করিয়া বলিল, পেনাম ঘোষমশাই।
মেয়েটি তাড়াতাড়ি দীর্ঘ অবগুণ্ঠন টানিয়া দিল।
তারিণী কহিল, আর সান কেড়ো না মা, দম লাও দম লাও। সেই যে বলে—লাজে মা কুঁকড়ি বেপদের ধুকুড়ি।
ঘোষমহাশয় বলিলেন, কী চাই তোর তারিণী, বল?
তারিণী মাথা চুলকাইয়া সারা হইল, কী তাহার চাই, সে ঠিক করিতে পারিল না। অবশেষে বলিল, এক হাঁড়ি মদের দাম—আট আনা।
জনতার মধ্য হইতে সেই সাবি মেয়েটি বলিয়া উঠিল, আ মরণ আমার! দামী কিছু চেয়ে নে রে বাপু!
তারিণীর যেন এতক্ষণে খেয়াল হইল, সে হেঁটমাথাতেই সলজ্জ হাসি হাসিয়া বলিল, ফাঁদি লত একখানা ঘোষ-মশাই।
জনতার মধ্য হইতেই সাবিই আবার বলিয়া উঠিল, হ্যাঁ বাবা তারিণী, বউমা বুঝি খুব নাক নেড়ে কথা কয়?
প্রফুল্লচিত্ত জনতার হাস্যধ্বনিতে খেয়াঘাট মুখরিত হইয়া উঠিল। বধূটি ঘোমটা খুলে নাই, দীর্ঘ অবগুণ্ঠনের মধ্য হইতে তাহার গৌরবর্ণ কচি হাতখানি বাহির হইয়া আসিল—রাঙা করতলের উপর সোনার নথখানি রৌদ্রাভায় ঝকঝক করিতেছে।
ঘোষমহাশয় বলিলেন, দশহরার সময় পার্বণী রইল তোর কাপড় আর চাদর, বুঝলি তারিণী? আর এই নে পাঁচ টাকা।
তারিণী কৃতজ্ঞতায় নত হইয়া প্রণাম করিল, আজ্ঞে হুজুর, চাদরের বদলে যদি শাড়ি—
হাসিয়া ঘোষ মহাশয় বলিলেন, তাই হবে রে, তাই হবে।
সাবি বলিল, তোর বউকে একবার দেখতাম তারিণী।
তারিণী বলিল, নেহাত কালো কুচ্ছিত মা।
তারিণী সেদিন রাত্রে বাড়ি ফিরিল আকণ্ঠ মদ গিলিয়া। এখানে পা ফেলিতে পা পড়িতেছিল ওখানো সে বিরক্ত হইয়া কালাচাঁদকে বলিল, রাস্তায় এত নেলা কে কাটলে রে কেলে? শুধুই নেলা—শুধুই নেলা—শুধুই নেলা—শুধুই—অ্যা—অ্যাই—একটো—
কালাচাঁদও নেশায় বিভোর, সে শুধু বলিল, হুঁ।
তারিণী বলিল, জলাম্পয়—সব জলাম্পয় হয়ে যায়, সাঁতরে বাড়ি চলে যাই। শালা খাল নাই, নেলা নাই, সমান সব সমান।
টলিতে টলিতেই সে শূন্যের বায়ুমণ্ডলে হাত ছুঁড়িয়া হুঁড়িয়া সাঁতারের অভিনয় করিয়া চলিয়াছিল।
গ্রামের প্রান্তেই বাড়ি। বাড়ির দরজায় একটা আলো জ্বালিয়া দাঁড়াইয়া ছিল সুখী—তারিণীর স্ত্রী।
তারিণী গান ধরিয়া দিল, লো—তুন হয়েছে দেশে ফাঁদি লতে আমদানি–
সুখী তাহার হাত ধরিয়া বলিল, খুব হয়েছে, এখন এস। ভাত কটা জুড়িয়ে কড়কড়ে হিম হয়ে গেল।
হাতটা ছাড়াইয়া লইয়া কোমরের কাপড় খুঁজিতে খুঁজিতে তারিণী বলিল, আগে তোকে লত পরাতে হবো লত কই কই কোথা গেল শালার লত?
সুখী বলিল, কোন দিন ওই করতে গিয়ে আমার মাথা খাবে তুমি। এবার আমি গলায় দড়ি দেবো কিন্তু
তারিণী ফ্যাল ফ্যাল করিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কেনে, কি করলাম আমি?
সুখী দৃষ্টিতে তাহাকে তিরস্কার করিয়া বলিল, এই পাথার বান, আর তুমি–
তারিণীর অট্টহাসিতে বর্ষার রাত্রির সজল অন্ধকার ত্রস্ত হইয়া উঠিল হাসি থামাইয়া সে সুখীর দিকে চাহিয়া বলিল, মায়ের বুকে ভয় থাকে! বল তু বল, বলে যা বলছি। পেটের ভাত ঐ ময়ূরাক্ষীর দৌলতে জবাব দে কথার—আই!
সুখী তাহার সহিত আর বাক্যব্যয় না করিয়া ভাত বাড়িতে চলিয়া গেল।
তারিণী ডাকিল, সুখী, অ্যাই সুখী, অ্যাই!
সুখী কোনো উত্তর দিল না। তারিণী টলিতে টলিতে উঠিয়া ঘরের দিকে চলিল। পিছন হইতে ভাত বাড়িতে ব্যস্ত সুখীকে ধরিয়া বলিল, চল এখুনি তোকে যেতে হবে।
সুখী বলিল, ছাড়, কাপড় ছাড়।
তারিণী বলিল, আলবত যেতে হবে হাজার বার—তিনশো বারা
সুখী কাপড়টা টানিয়া বলিল, কাপড় ছাড় যাব, চলা তারিণী খুশি হইয়া কাপড় ছাড়িয়া দিল। সুখী ভাতের থালাটা লইয়া বাহির হইয়া গেল।
তারিণী বলিতেছিল, চল, তোকে পিঠে নিয়ে ঝাঁপ দোব গনুটের ঘাটে, উঠব পাঁচথুপীর ঘাটে।
সুখী বলিল, তাই যাবে, ভাত খেয়ে লাও দিকিনি।
বাহির হইয়া আসিতে গিয়া দরজায় চৌকাঠে কপালে আঘাত খাইয়া তারিণীর আস্ফালনটা একটু কমিয়া আসিল।
ভাত খাইতে খাইতে সে আবার আরম্ভ করিল, তুলি নাই সেবার এক জোড়া গোরু? পনের টাকা—পাঁচ টাকা কম এক কুড়ি, শালা মদন গোপ ঠকিয়ে নিলে? তোর হাতের শাঁখা-বাঁধা কী করে হল?বল, কে—তোর কোন নানা দিলে?
সুখী ঘরের মধ্যে আমানি ছাঁকিতেছিল, ঠাণ্ডা জিনিস নেশার পক্ষে ভালা তারিণী বলিল, শালা মদনা—নিলি ঠকিয়ে এলো সুখীর শাঁখাবাঁধা তো হয়েছে, বাস, আমাকে দিস আর না দিস? পড়ে শালা একদিন ময়ূরাক্ষীর বানে—শালাকে গোটা কতক চোবন দিয়ে তবে তুলি