কর্নেল মুরগির ঠ্যাং কামড়ে ধরে বললেন, উনি তোমাকে মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলেন এবং তুমিও মিথ্যা খুন-খারাপির কথা বলেছিলে তাকে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মিথ্যাগুলোর আড়ালে একটা কঠিন সত্য আছে। উনি তোমার কথা শুনে খুব অবাক হয়েছিলেন। তাই না?
ভীষণ অবাক।
তার মানে, উনি জানতেন কাউকে খুনের চেষ্টা হতে পারে। কিন্তু ওঁর ধারণা ছিল, তাকে খুন করা সম্ভব নয় এবং কোনও ভাবেই নয়। যাই হোক, বটকৃষ্ণবাবুকে মুখোমুখি না পেলে কিছু জানা যাবে না।
খাওয়া শেষ করে আমরা ঘরে ফিরলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি কমে এসেছে। কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে চুরুট ধরালেন। সেই সময় হঠাৎ পিছনের খোলা জানালার নিচে ভিজে কাগজের একটা মোড়ক দেখতে পেলাম। সেটা তুলে নিয়ে দেখি, একপাটি পামসু। চমকে ওঠে বললাম, কর্নেল! কর্নেল! একপাটি জুতো। পামসু।
কর্নেল একবার দেখে নিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, রেখে দাও—
০৫. খণ্ডহরে জোড়া লাশ
জুতোটা যে বটকৃষ্ণবাবুই কখন চুপি চুপি এসে জানালা গলিয়ে ফেলে গিয়েছিলেন তাতে ভুল নেই। কিন্তু ভদ্রলোক কেন আর আমাদের মুখোমুখি হচ্ছেন না, এটাই অদ্ভুত। কর্নেল কিন্তু তেমনই নির্বিকার। শুয়ে শুয়ে দেখছিলাম, টেবিলবাতির আলোয় একটা গাব্দা বই পড়ছেন। বাইরে বেড়াতে এলেও উনি বইপত্র সঙ্গে আনেন। নিশ্চয় প্রজাপতি-অর্কিড-পাখি কিংবা প্রকৃতি সংক্রান্ত বই ওটা।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম এবং সেই ঘুম ভাঙল কর্নেলের ডাকে। ঘরে দিনের আলো। আজ আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার। বারান্দায় রোদ্দুর ঝলমল করছে।
সুপ্রভাত ডার্লিং। বলে কর্নেল টেবিলের উপর কিটব্যগ রাখলেন। লক্ষ্য করলাম, অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণে গিয়েছিলেন। ক্যামেরা এব° বাইনোকুলার রেখে পা থেকে হান্টিং বুট খুললেন। রেন-জ্যাকেট তো বটেই, টুপি এবং দাড়িতে মাকড়সার জাল, পাতার কুচি ইত্যাদির নৈসর্গিক আবর্জনা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হলেন।
প্রায় আটটা বাজে। চুপচাপ বাথরুমে গেলাম। ফিরে এসে দেখলাম, কর্নেল পোশাক বদলেছে। কৃপানাথ টেবিলে কফির পট, পেয়ালা, কিছু স্ন্যাক্স রেখে। গেছে। বললাম, কেল্লাবাড়িতে গিয়েছিলেন নাকি?
যাওয়া উচিত। যাব।
আপনি বটকৃষ্ণবাবুর চিঠিটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
দিচ্ছি। তবে প্রথম গুরুত্ব ওঁর রেখে যাওয়া একপাটি জুতো। কর্নেল হাসলেন। কিন্তু মজার কথা, এই একপাটি জুতো বাঁ পায়ের। ডান পায়ের জুতোটা বাংলোর নিচেই ঝোঁপের ভেতর কুড়িয়ে পেয়েছি। সস্তা রবারের পামসু। নবকুমারবাবুর মতো ধনী ব্যবসায়ীর পায়ে এমন জুতো শোভা পায় না। হুঁ, সেকেলে স্বভাবের হাড়কিপটে ব্যবসায়ীরা এমন সাদাসিধে জুতো পরতেই পারেন। কিন্তু জয়ন্ত, জুতো জোড়া ৬ নম্বরী। তার মানে খর্বকায় শীর্ণদেহী লোকের জুতো। এবং নতুন জুতো। কর্নেল টেবিলের তলায় রাখা জুতোজোড়া দেখিয়ে দিলেন।
আপনি যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছেন দেখছি।
হ্যাঁ বটকৃষ্ণবাবুকে ফেরত দের। কারণ এ জুতো কলকাতা থেকে সদ্য কেনা। হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ওঁর পায়ে এই জুতো পরশু সন্ধ্যায় দেখেছিলাম।
হেসে ফেললাম। আপনি লক্ষ্য করেছিলেন তা হলে?
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, কিন্তু প্রশ্ন হল, বটকৃষ্ণবাবু এভাবে আমাকে কার সঙ্গে লড়িয়ে দিতে চাইছেন? শুধু বুঝতে পারছি, এবার উনি কেল্লাবাড়ির ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ঘটাতে তৎপর হয়েছেন। দেখা যাক।
লোকটা অদ্ভুত।
কর্নেল আমার মন্তব্যে কান করলেন না। ঘড়ি দেখে বললেন, রহমত জিপ নিয়ে আসতে দেরি করছে কেন? তার আটটা নাগাদ এসে যাওয়ার কথা।
উনি বারান্দায় গিয়ে বাইনোকুলারে সম্ভবত রহমতের ধাবমান জিপ খুজতে থাকলেন। আমি রাতের পোশাক বদলে নিলাম।
রহমতের জিপ এল প্রায় পৌনে ন টায়। সামরিক সেলাম ঠুকে উদ্বিগ্ন মুখে বলল, বড়া খতরনাক কর্নিলসাব। সেইজন্য আসতে দেরি হল। কেল্লা বাড়ির খণ্ডহরে একজন বাঙালিবাবু খুন হয়েছেন। পাটোয়ারিজির পুরানা গদিতে কাজ করতেন উনি। খুব ভিড় হয়েছে। পুলিশ গেছে। তো–
কর্নেল কিছু বলার আগেই আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম, বটকৃষ্ণবাবু!
রহমত বলল, জি সাব। ওহি বাবু। লাশ পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে।
কর্নেল চুপচাপ জিপের কাছে গেলেন। আমাকে উঠতে ইশারা করলেন। তারপর রহমত স্টিয়ারিঙে বসলে বললেন, কেল্লাবাড়ি।
বাঙালি এলাকা ছাড়িয়ে সদর রাস্তা থেকে জিপ সংকীর্ণ এবড়ো-খেবড়ো একটা রাস্তায় বাঁক নিল। এদিকটায় অসমতল মাটি রন জঙ্গলে ঢাকা। কিছু লোক সেই রাস্তায় ফিরে আসছিল। তারা আমাদের জিপ দেখে একবার থমকে দাঁড়াল। উত্তেজিতভাবে কিছু বলাবলি করল। তারপর চলে গেল। বুঝলাম তারা অত্যুৎসাহী প্রকৃতির লোক এবং অকুস্থল থেকে ফিরে আসছে।
জিপ যেখানে থামল, সেখানেই এই রাস্তার শেষ। সামনে গভীর গড়খাই জলে ভরা। একখানে বড় বড় পাথর পড়ে আছে সেই গড়খাইয়ে। তার ওধারে পাথুরে পাঁচিল ভেঙে পড়েছে। ভেতরে উঁচু-নিচু গাছ ঝোপঝাড় এবং ধ্বংসস্তূপ। তার ফাঁকে জরাজীর্ণ একটা বিশাল ইটের বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। রহমতের সঙ্গে পাথরের উপর দিয়ে আমরা কেল্লাবাড়িতে ঢুকলাম। পায়ে চলা পথ দেখে বোঝা গেল কৃপানাথের কথা ঠিক নয়। কেল্লাবাড়িতে লোক চলাচল করে। সম্ভবত গরিব লোকেরা জ্বালানি কাঠ, ফলমূল সংগ্রহের জন্য এবং পাখি বা ছোট জন্তু শিকারেও আসে। একটু পরে দুধারে দুটো পুকুর দেখা গেল। ঘন জলজ গাছে ঢাকা। দুটোতেই পাথরের ভাঙাচোরা ঘাট আছে এবং ঘাটের দুদিকে বিধ্বস্ত কোনও ভাস্কর্যের চিহ্নও আছে। মধ্যিখানে পাথরের ইটে বাঁধানো পথ। সেই পথের অবস্থা শোচনীয়। ফাটলে ঘাস আর ঝোপ গজিয়েছে। পথের দুধারে প্রাচীন পামগাছের সারি ঢাকা পড়েছে বিশাল সব গাছের তলায়। প্রকাণ্ড লতা ঝুলছে। ইটের বাড়িটা মুখ থুবড়ে পড়েছে। দরজা-জানালার কাঠ লুঠ হয়ে গেছে কবে। বাড়ির সামনে প্রশস্ত সোপানের চিহ্ন টিকে আছে। রহমত সেই সোপানের কাছে গিয়ে বলল, এইখানে লাশ পড়েছিল। এই দেখুন কর্নিলসাব। এখনও রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে। ভোরে আবার খুব বৃষ্টি হয়েছিল। তাই রক্ত ধুয়ে গেছে।