প্রায় কুড়ি মিনিট পর আলো-আঁধারি পরিবেশে জনহীন নিঝুম একটা এলাকায় পৌঁছলাম। রহমত একটা সংকীর্ণ পিচের রাস্তায় জিপ ঘোরালো। রাস্তার দুধারে ঘন গাছপালা এবং অসমতল মাটিতে পুরনো নতুন একটা করে বাড়ি জিপের আলোয় দেখা যাচ্ছিল। রাস্তার ধারে কিছুদূর অন্তর একটা করে কাঠের ল্যাম্পপোস্ট আছে বটে, কিন্তু বাতিগুলো ম্লান এবং কোনও কোনও বাতি গাছের পাতার আড়ালে ঢাকা পড়েছে। এই সন্ধ্যারাত্রে রাস্তাটা এমন জনহীন যে একা পায়ে হেঁটে গেলে গা ছমছম করতেই পারে। বৃষ্টি বন্ধ এবং বাতাস বইছে না। তাই গুমোট গরম। একখানে জিপ আবার ঘুরল এবং কিছুটা এগিয়ে থামল। রহমত জিপ থেকে নেমে বলল, এই বাড়ি কর্নিলসাব। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি খবর দিয়ে আসি।
ডানদিকে একটা নতুন দোতলা বাড়ি। তবে পাটোয়ারিজির বাড়ির মতো ছিমছাম নয়। বাড়িটা সদ্য তৈরি হয়েছে মনে হচ্ছিল। একটু পরে কুকুরের হাঁকডাক শোনা গেল। তারপর হেঁড়ে গলায় দোতলা থেকে কেউ বললেন, কে? কি চাই?
রহমত বলল, বাবুজি। কলকাতা থেকে কর্নিলসাব এসেছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
কর্নেলের সঙ্গে আমি নামলাম জিপ থেকে। গেটের ভেতর থেকে একঝলক টর্চের আলো এসে আমাদের মুখে পড়ল। সেই সঙ্গে কুকুরের হাঁকডাক। দেখলাম, বন্ধ গেটের ভেতরে একজন পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। তার একহাতে প্রকাণ্ড অ্যালসেশিয়ানের গলার চেন। কুকুরটা গেটের গরাদে দুই ঠ্যাং তুলে গর্জন করছে।
কর্নেল বললেন, আমি নবকুমারবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
বাবা তো নেই। দুদিন আগে কলকাতা গেছেন। আজ ফেরার কথা ছিল। রাতের ট্রেনে ফিরতেও পারেন।
আপনি কি সুনীলবাবু?
হ্যাঁ। তো অনিল–আমার ভাই জানিয়ে গেছে, জেঠিমা আমাদের পেছনে পুলিশ লাগিয়েছেন। দেখুন স্যার, আমরা জেঠিমার কোনও সাতেপাঁচে নেই।
সুনীলবাবু। আমরা পুলিশ নই। অনিলবাবুকে বলেছি– অনিল একটা গবেট। সুনীলবাবু খাপ্পা মেজাজে বললেন, ওর বোকামির জন্যই বাবা ওকে পছন্দ করেন না। ঘরের শত্রু বিভীষণ। আজ আবার ভালমানুষি করে বলতে এসেছিল, জেঠিমা কলকাতা থেকে সি আই ডি অফিসার পাঠিয়েছেন।
কর্নেল বললেন, উনি বটকৃষ্ণবাবুর কথা বলেননি?
সুনীলবাবু অ্যালসেশিয়ানটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গর্জন করলেন, বটোকেষ্টকে গুলি করে মারা উচিত। ঠগ। জোচ্চোর। ধান্দাবাজ। সেই আমাদের বিরুদ্ধে জেঠিমার কান ভারি করত। এখনও কলকাতা গিয়ে তাই করছে। করুক না। ভেবেছে, পাটোয়ারির গুণ্ডারা ওর পিঠ বাঁচাবে? চামড়া খুলে নেব।
নিশ্চয় নেবেন। তা সুনীলবাবু, জমিদার রায়বাবুদের সঙ্গে আপনাদের মামলার কি অবস্থা?
সুনীলবাবু একটু দমে গেলেন যেন। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললেন, দেখুন স্যার, এসব ব্যাপারে যা বলার বাবা বলবেন। তবে জেঠিমা যখন আপনাদের হেল্প নিয়েছেন, তখন জেঠিমার কাছেই জানতে পারতেন মামলার কি অবস্থা। প্লিজ, আপনারা পরে খোঁজ নেবেন! বাবা ফিরে আসুন।
এই সময় টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। আমরা জিপে উঠলাম। কর্নেল রহমতকে বললেন, সোজা ফরেস্ট বাংলো।
ফরেস্ট বাংলোয় পৌঁছনোর আগেই তুমুল বৃষ্টি নামল। জিপের সামনে কর্নেলের বাঁদিকে এবং রহমতের ডানদিকে ঠাসবন্দি অবস্থায় বসার ফলে আমি তত ভিজলাম না। কিন্তু বৃষ্টিরোধী জ্যাকেট পরা সত্ত্বেও কর্নেল যথেষ্ট ভিজলেন। পর্দাটা ছেঁড়া। আটকাতে পারলেন না। ওঁর সাদা দাড়ি থেকে ঝরনা ঝরতে থাকল। টুপিতে অবশ্য টাক বাঁচল।
বাংলোয় আমাদের পৌঁছে দিয়ে রহমত চলে গেল জিপ নিয়ে। কৃপানাথ দৌড়ে এল। কর্নেল তাকে কড়া কফির হুকুম দিলেন। সেইসময় কৃপানাথ পকেট থেকে একটা ভাঁজকরা কাগজ কর্নেলকে দিয়ে বলল, এক বাঙালিবাবু কিছুক্ষণ আগে চিঠিটা দিয়ে গেলেন। চেনা-চেনা মনে হচ্ছিল।
তাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, জলদি কফি।
কৃপানাথ চলে গেলে চিঠিটা খুলে কর্নেল পড়লেন। তারপর নির্বিকার মুখে। আমার হাতে দিলেন। পড়ে দেখি, লেখা আছে–
মহামান্য কর্নেল নীলাদ্রি সরকার মহাশয়
সমীপেষু,
যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহাই ঘটিয়াছে। পুরানা বাজারে যখন আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তখন পাটোয়ারিজির গুণ্ডারা আশেপাশে ছিল। আপনার সহিত কথাবার্তা বলিলে তাহাদের সন্দেহ হইবে ভাবিয়া শীঘ্রই সরিয়া পড়ি। এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। তবে বিশেষ ঘটনা, অদ্য বৈকালে কেল্লাবাড়ির একটি ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপ-চাপ রক্ত এবং একটি পামসু জুতা আবিষ্কার করিয়াছি। পামসু পাটি চিনিতে পারিয়াছি। উহা শ্রীনবকুমার সাঁতরার। আপনি অনুগ্রহপূর্বক তদন্ত করুন, সাঁতরাবাবুকে কে হত্যা করিয়াছে। আমি আড়ালে থাকিয়া এইরূপে আপনাকে সহযোগিতা করিব।
প্রণাম জানিবেন।
ইতি শ্ৰীবটকৃষ্ণ গুঁই……
০৪. জল্পনা এবং জুতো
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির রাতে বনবাংলোর বারান্দায় বসে কফি পানের এই অভিজ্ঞতা তুলনাহীন। বৃদ্ধ প্রকৃতি প্রেমিক মুগ্ধভাবে কথাগুলি উচ্চারণ করলেন। তারপর চুরুট জ্বেলে আমার দিকে তাকালেন। তোমাকে বলেছিলাম জয়ন্ত, ভীমগড়ের বৃষ্টি ভীমের মতোই দুর্ধর্ষ।
আমার মনে বটকৃষ্ণবাবুর চিঠিটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। বৃষ্টির দিকে মন যাচ্ছিল না। ভদ্রলোক একবার না হয় কোনও কারণে মিথ্যা বলেছেন, দ্বিতীয়বারও কি মিথ্যা বলবেন? বিশেষ করে নবকুমারবাবুর এক পাটি পামসু এবং রক্ত। আবিষ্কারের মতো সাংঘাতিক ধোঁকাবাজি করবেন