কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। তারপর পকেট থেকে একটা নেমকার্ড দিলেন। সুন্দরজির সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। আপনিই কি–
ভদ্রলোক কার্ডটা দেখছিলেন। বললেন, আমি সুন্দরজির কোম্পানির ম্যানেজার। আমার নাম রাকেশ শর্মা। আপনারা ভেতরে এসে বসুন। আমি ওঁকে খবর দিচ্ছি।
বসার ঘরটা সুন্দরভাবে সাজানো। মেঝেয় দামি কার্পেট। একদিকের দেয়াল। ঘেঁষে সার সার গদিআটা চেয়ার। অন্যদিকে সোফাসেট। আলমারিতে দেশ বিদেশের পুতুল, ইতস্তত সাজিয়ে রাখা ভাস্কর্য, শেলফে কিছু ঝকঝকে মলাটের বই। দেয়ালে কয়েকটা চিত্রকলা। দেবদেবীর মূর্তিও চোখে পড়ল এবং সেগুলি উৎকৃষ্ট শিল্প নিদর্শন। সুন্দরজি আধুনিক রুচির মানুষ, তাতে সন্দেহ নেই।
রাকেশ শর্মা আমাদের বসিয়ে পর্দা তুলে ভেতরে গিয়েছিলেন, একটু পরে ফিরে এসে বললেন, সুন্দরজি আসছেন, আপনারা বসুন।
বলে উনি বাইরে চলে গেলেন। মিনিট কয়েক পরে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক শক্তসমর্থ গড়নের বৃদ্ধ ঘরে ঢুকে নমস্কার করে অমায়িক কণ্ঠস্বরে ইংরেজিতে বললেন, বলুন কর্নেল সরকার। আপনার জন্য কি করতে পারি?
তার হাতে কর্নেলের কার্ড এবং একটা ছড়ি ছিল। তিনি কর্নেলের দিকে তাকিয়ে কথা বললেন, একটু অবাক হলাম, তা ঠিকই। তবে আমাদের দুজনের মধ্যে কার কর্নেল হওয়া সম্ভব, সেটা হয়তো চেহারা ও ব্যক্তিত্ব দেখেই জানা সম্ভব।
কর্নেল বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। কলকাতার বিখ্যাত দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী।
সুন্দরজি আমাকে দেখি নিয়ে সহাস্যে বললেন, আমি কি সংবাদ হওয়ার মতো কিছু কাজ করেছি?
কর্নেল হাসলেন। নাহ্ সুন্দরজি। জয়ন্ত আমার সঙ্গে এখানে বেড়াতে এসেছে।
আপনি রিটায়ার্ড সামরিক অফিসার। সরকারের পক্ষ থেকে কোনও কাজে এসেছেন কি? ঠিক আছে। বলুন কি কাজ?
সরকারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই সুন্দরজি। আমি এখানে বেড়াতেই এসেছি। তো শুনলাম, আপনি এখানকার পুরনো বাসিন্দা। তাই একটা কথা জানতে এলাম।
বলুন কি জানতে চান?
এখানে একটা কেল্লাবাড়ির মালিক ছিলেন বাঙালি জমিদার। তারা দুই ভাই। প্রশান্ত রায় এবং প্রসন্ন রায়। তাদের নিশ্চয় চিনতেন?
সুন্দরজি ভুরু কুঁচকে বললেন, চিনতাম। প্রশান্ত বছর পঁচিশ আগে সন্ন্যাসী হয়ে চলে যায়। আমার বন্ধু ছিল সে। ছোটবেলা থেকেই ধর্মকর্ম নিয়ে থাকত। প্রসন্ন উল্টো স্বভাবের লোক। ভীমগড়ের বাঙালিবাজারে আমার মতোই এক কারবারি বাঙালি পরিবার আছে। তাদের সঙ্গে প্রসন্নের জমিজায়গা নিয়ে মামলা বেধেছিল। প্রসন্নও এখান থেকে চলে যায়। সে-ও প্রায় বিশ বছর আগের কথা।
কোন্ জমি নিয়ে মামলা হয়েছিল জানেন নিশ্চয়?
কেল্লাবাড়ির একটা জমি নিয়ে। জমিটা একর তিনেক হবে। প্রশান্ত নাকি সন্ন্যাসী হওয়ার আগে জমিটা ওই কারবারি ফ্যামিলির বড়কর্তা সত্যকুমার সাঁতরাকে বেচেছিল। সত্যরাবু মারা গেছেন। তাঁর ছোট ভাই নবকুমার ঝানু লোক। আমি তাকে পছন্দ করি না। না, কারবারি প্রতিযোগিতার প্রশ্ন নয়। লোকটা কুচুটে স্বভাবের। নিজের ছেলের সঙ্গেই বনিবনা হয় না। ছেলে অনিল তাই চাকরি করছে। পোস্টমাস্টার হয়েছে।
বটকৃষ্ণবাবু নামে এক ভদ্রলোক আপনার গদিতে কাজ করেন শুনলাম। তিনি নাকি পোস্টম্যান ছিলেন?
সুন্দরজির মুখে সন্দিগ্ধ ভাব ফুটে উঠল। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকার পর বললেন, আপনার এসব কথাবার্তা বলতে আসার উদ্দেশ্য কি? কে আপনি?
কর্নেল হাসলেন, কার্ডেই আমার পরিচয় লেখা আছে। তবে বটকৃষ্ণবাবু আমাকে–
সুন্দরজি ওঁর কথার উপর বললেন, চিট করেছে? কিভাবে ওর পাল্লায় পড়লেন?
যেভাবে আপনি ওর পাল্লায় পড়েছেন।
তার মানে? কি বলতে চান আপনি?
কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে ভঁজকরা সেই শব্দছক আঁকা পুরনো কাগজটা বের করে খুললেন। বললেন, দেখুন তো, এটা চিনতে পারেন কি না?
সুদরজির মুখের ভাব মুহূর্তে বদলে গেল। প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন, কে আপনি?
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার পরামর্শ সুন্দরজি, আপনি যেন এই ফাঁদে পা দেবেন না। আপনার এই ঘরে সাজানো ভাস্কর্যগুলো দেখেই বুঝতে পেরেছি, আপনি প্রাচীন ভারতীয় শিল্পনিদর্শনের সমঝদার। কিন্তু আপনাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত, বটকৃষ্ণবাবুর নির্বুদ্ধিতায় আপনার বিপদ ঘটতে পারে। তিনি আপনাকে লোভ দেখিয়ে চাকরি আদায় করেছেন। আমি বলছি না। বেচারাকে বরখাস্ত করুন। শুধু বলছি বটকৃষ্ণবাবুর কথায় চলবেন না।
বলে কর্নেল দ্রুত ঘর থেকে বেরুলেন। সুন্দরজি রুষ্ট মুখে বসে রইলেন। জিপে উঠে বললাম, আপনি যেন সুন্দরজিকে হুমকি দিতেই গিয়েছিলেন। ব্যাপারটা কি?
কর্নেল আমার কথার উত্তর না দিয়ে রহমতকে বললেন, রহমত। তুমি নবকুমার সাঁতরার বাড়ি চেনো?
রহমত বলল, ওঁর বাড়ি নদীর ধারে বাঙালি বাজারের শেষ দিকে। পাশেই একটা খণ্ডহর আছে কর্নিলসাব। জমিদারবাবুদের কেল্লাবাড়ি। ওঁরাও বাঙালি ছিলেন।
জানি। নবকুমারবাবুর বাড়ি পর্যন্ত জিপ যাবে তো?
যাবে কর্নিলসাব। বাবুজি নতুন বাড়ি বানিয়েছেন পুরনো বাড়ির পাশে। পুরনো বাড়িতে ওঁর ছেলে থাকে। পোস্টমাস্টার অনিলবাবু।
অনিলবাবুর ভাই নেই?
আছে। সুনীলবাবু বড়। অনিলবাবু ছোট। ওঁর বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে। সুনীলবাবু বাবার সঙ্গে কারবার দেখাশোনা করেন।