পাটোয়ারিজির ভাতিজা ভদ্রলোক কেমন যেন নির্লিপ্ত উদাসীন প্রকৃতির মানুষ। কর্নেলকে পাত্তা দিলেন না, জিজ্ঞেসও করলেন না কিছু।
ফিরে আসতে আসতে বললাম, লোকটা বড় অভদ্র তো!
কর্নেল আনমনে বললেন, কেন?
কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। গ্রাহ্যও করলেন না।
কর্নেল হাসলেন। টিপিক্যাল ঝানু ব্যবসায়ীরা লোক চেনেন। দেখেই আঁচ করেছেন, আমরা কারবারি কাজে আসিনি। সন্দেহও হয়ে থাকবে সরকারি লোক কি না। পাত্তা দেওয়া মানে পয়সা খরচ। যদি আমরা কিছু চার্জ করি, তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে। এই হল এখানকার কারবারিদের বাঁধা ছক।
বটকৃষ্ণবাবুর কীর্তিকলাপ সত্যিই রহস্যজনক। তবে আপনার আচরণও কম রহস্যজনক নয়! আমাকে খুলে বললেই পারেন, কলকাতার দয়াময়ী দেবী আপনাকে একটা কেস দিয়েছেন।
না জয়ন্ত। কেস উনি দেননি। আমিই নিয়েছি। নিছক অনুসন্ধিৎসা। তবে বটকৃষ্ণবাবুর কথা দয়াময়ী আমাকে বলেননি। লেটারবক্সে বছর তিনেক আগে খামটা পেয়েছিলেন। কৌতূহলবশত খুলে দেখে অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারেননি। তবে বুদ্ধিমতী মহিলা। জমিদার রায়বাবুদের সঙ্গে ওঁর স্বামীর ফ্যামিলির বিবাদ ছিল জমি-জায়গা নিয়ে। তাই খামটা লুকিয়ে রেখেছিলেন, কোনও দিন কাজে লাগবে ভেবেই।
ওঁর পোষ্যপুত্রকে জানাননি?
পোষ্যপুত্রের কথা আমাকে দয়াময়ী বলেননি। তবে ওঁর কথায় আঁচ করেছি, এই খামের কথা উনি ঘুণাক্ষরে কাকেও বলেননি। কদিন আগে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তো আমার পরিচয় পেয়ে। উনি–
ভিড়ে ঠাসা ঘিঞ্জি গলিতে পিচ্ছিল পাথুরে ইটের ওপর হাঁটতে হাঁটতে বাক্যালাপের বিপদ আছে। বার দুই পা হড়কে পড়তে পড়তে টাল খেয়েছিলাম। তৃতীয়বার পড়েই পেলাম। নোংরায় প্যান্টের অবস্থা শোচনীয় হল। দুটো হাতে কাদা মেখে গেল। কিন্তু ভাগ্যিস আঘাত পেলাম না। ভিড়ের কেউ আমাকে সাহায্য করার আগেই উঠে দাঁড়ালাম। কেউ কেউ জলের কল দেখিয়ে দিল সমবেদনায়।
কিন্তু কর্নেল কোথায়?
একটু পরে তাকে আবিষ্কার করলাম। গলির বাঁকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে চুরুট ধরাচ্ছেন। কাছে গেলে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ফলপট্টির ভেতর হাঁটার সময় সতর্ক থাকা উচিত। বিশেষ করে যদি দুধারে পাকা কলার কাদি দেখা যায়। যাই হোক, তোমার জন্য এই ট্যাপের কাছে অপেক্ষা করাই উচিত মনে করেছিলাম। ধুয়ে নাও। বাংলোয় ফিরে পোশাক বদলাবে।
অগত্যা ট্যাপের জলে যতটা পারা যায় ধুয়ে পেলে বললাম, যত বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি জায়গায় আপনার যাতায়াত। এই নোংরা কাদার দুর্গন্ধ ছ্যাঃ।
কনেল পা বাড়িয়ে বললেন, তোমার চেয়ে বটকৃষ্ণবাবুর অবস্থা শোচনীয়। বেচারা ভিড় ঠেলে পালাতে গিয়ে একবারে ড্রেনে পড়লেন। আমি ওঁকেই ওঠাতে গেলাম। কিন্তু উনি কাদায় ভূত হয়ে ভূতের মতোই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। একেই বলে ভূতের চেয়ে অদ্ভুত।
বলেন কি! বটকৃষ্ণবাবুকে দেখেছেন? চোখের ভুল নয় তো?
নাহ্। আপন মনে উনি আসছিলেন। হাতে অবশ্য ব্রিফকেস ছিল না। আমাকে দেখামাত্র গা ঢাকা দিতে গিয়ে কেলেঙ্কারি। কর্নেল স্বভাবসিদ্ধ অট্টহাসি হাসলেন। তারপর জিপের কাছাকাছি পৌঁছে আপনমনে বললেন, বটকৃষ্ণবাবু একটা ভাইট্যাল পয়েন্ট। ওঁকে না পেলে খড়ের গাদায় সুচ খুঁজে হন্যে হব।
০৩. বটকৃষ্ণবাবুর চিঠি
কর্নেল জিপে উঠেই রহমতকে বললেন, নিউ টাউনশিপে পাটোয়ারিজির কোম্পানির অফিসে যাব। তুমি কি অফিসটা চেনো রহমত?
রহমত হাসল। চিনি কর্নিয়ালসাব। এখানে সুন্দর সিং পাটোয়ারিজিকে চেনে না এমন লোক নেই। বহৎ কড়া আদমি। মিনিস্টাররাও ওঁকে খুব খাতির করেন। সে জিপ স্টার্ট দিয়ে ফের বলল, পুরানা বাজারে ওঁর ভাতিজা মোহন সিং পাটোয়ারিজিকেও চিনি। খুব দেমাগি লোক। সুন্দর সিং পাটোয়ারি তাকে বিশ্বাস করেন বটে, কিন্তু আমার মনে হয়, একদিন ওই ভাতিজাই ওঁকে পথে বসাবে।
কেন একথা তোমার মনে হয়?
মোহনজির হাতে অনেক গুণ্ডা-বদমাইস আছে। সুন্দরজিও ওকে ভয় করে চলেন। ভাতিজা মোহনজির বেনামে দুসরা কারবার আছে, সুন্দরজি তা জেনেও চুপ করে আছেন।
তুমি বটকৃষ্ণবাবুকে চেনো? আগে পোস্টম্যান ছিলেন। এখন মোহনজির গদিতে কাজ করেন।
রহমত বাকামুখে বলল, চোট্টামি করে বেড়ায়। নেশাখোর। মোহনজির লোক বলে তাকে কেউ কিছু বলতে পারে না। জেলখাটা লোক।
কর্নেল সারা পথ রহমতের সঙ্গে এইসব কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন। নিউ টাউনশিপ এলাকায় তখন আলো ঝলমল করছে। ছিমছাম সুদৃশ্য পরিবেশ। রহমত একখানে জিপ থামিয়ে বলল, সুন্দরজির অফিস বন্ধ দেখছি। তবে পাশেই ওঁর বাড়ি। আমি দেখে আসি উনি আছে কি না।
সে জিপ থেকে নেমে বাঁদিকে একটু বিরাট দোতলা বাড়ির গেটে গেল। গেটে দারোয়ান ছিল। তার সঙ্গে কথা বলে ফিরে এল রহমত। বলল, সুন্দর আছেন। আমি দাবোয়ানকে বলে এলাম, কলকাতা থেকে কনিয়ালসাব দেখা করতে এসেছে।
কর্নেল জিপ থেকে নামলেন। ওঁকে অনুসরণ করলাম। বুঝতে পারছিলাম না কেন কর্নেল এই ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন।
দারোয়ান কর্নেলকে দেখে সেলাম ঠুকে গেটের একটা অংশ খুলে দিল। সাজানোলন এবং ফুলবাগিচা দেখে বুঝলাম সুন্দরজি সেকেলে ব্যবসায়ী নন। পোর্টিকোর সামনে স্মার্ট চেহারা এবং প্যান্ট-শার্ট পরা একজন মধ্যবয়সী লোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। ইংরেজিতে বললেন, আপনারা কলকাতা থেকে আসছে?