উনি একটু অবাক হয়ে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনারা কোথা থেকে আসছেন?
কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছি। আপনার নাম কি অনিলকুমার সাঁতরা?
হ্যাঁ। আপনি–
এখন আমিই অবাক এবং হতবাক। হাওড়া স্টেশনের সেই ভদ্রলোক ইনি নন।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, মিসেস দয়াময়ী সাঁতরা আপনার আত্মীয়া?
অনিবাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর ফেস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, জেঠিমা তাহলে তলে তলে পুলিশকে অ্যাপ্রোচ করেছেন। কোনও মানে হয়?
কর্নেল পকেট থেকে তার নেমকার্ড বের করে দিয়ে বললেন, না অনিলবাবু। আমরা পুলিশের লোক নই। আপনার জেঠিমার সঙ্গে কলকাতায় এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আলাপ হয়েছিল। তো আপনার পদবি সাঁতরা বলেই কথাটা মাথায় এল। আপনার নাম অবশ্য এখানে বেড়াতে এসে জানতে পেরেছি। দৈবাৎ একটা যোগাযোগ আর কি!
অনিলবাবু কার্ডটা দেখছিলেন। নার্ভাস মুখে হেসে বললেন, ভীমগড়ে সাঁতরা ফ্যামিলি একটাই। জ্যাঠামশাই মারা যাওয়ার পর জেঠিমা কলকাতার বাড়িতে গিয়ে আছেন। খুলেই বলি। জেঠিমার একটু সন্দেহবাতিক আছে। সব সময় ওঁর সন্দেহ, আমরা ওঁকে প্রপার্টির ন্যায্য শেয়ার থেকে বঞ্চিত করেছি। সন্তানাদি না থাকায় পোষ্যপুত্র নিয়েছেন। যত অশান্তির মূলে এই গুণ্ডাটা। তা চা-ফা বলি কর্নেলসায়েব?
ধন্যবাদ। কর্নেল অমায়িক কণ্ঠস্বরে বললেন, আপনার জেঠিমার পোষ্যপুত্রের নাম কি?
অচিন্ত্য। ভীমগড়েই ওদের বাড়ি ছিল। ওর বাবা ছিলেন জমিদারবাবুদের কর্মচারী। বলে অনিলবাবু আবার সেইরকম ভুরু কুঁচকে তাকালেন। অচিন্তাকে চেনেন নাকি?
না। সে কোথায় থাকে?
কলকাতায় জেঠিমার কাছেই থাকে। কালেভদ্রে জেঠিমা এখানে এলে সঙ্গে আসে। জ্যাঠামশাইয়ের জীবদ্দশায় বাড়ির একটা অংশ পার্টিশন করা হয়েছিল। এলে সেখানেই ওঠেন। অনিলবাবু হাসবার চেষ্টা করে বিকৃত মুখে ফের বললেন, গত মাসে এসে হঠাৎ হইচই বাধিয়েছিলেন। তালা ভেঙে কি কি সব চুরি গিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার দেখুন–চুরি যদি হবে, পুলিশকে জানাক। তা নয়, খামোকা চাঁচামেচি। শাসানি। আসলে অচিন্ত্য ওঁকে সামনে। রেখে আমাদের সঙ্গে ঝামেলা বাধাতে চায়। তা বাধাক। উই আর রেডি টু ফেস–
উঠি অনিলবাবু। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে বললেন, কাল সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। রোগা, বেঁটে মতো। লম্বা নাক। বলছিলেন, তাঁর নাম নাকি অনিলকুমার সাঁতরা। ভীমগড়ের পোস্টমাস্টার। তো দেখছি, উনি মিথ্যা বলছিলেন।
অনিলবাবু উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, অ্যাঁ? সে কি কথা!
কর্নেল হাসলেন। কত লোক কত ধান্দায় থাকে।
অনিলবাবুকে উত্তেজিত মনে হল। ডাকলেন, শচীন। ও শচীন। আবার সেই কেলোর কীর্তি। বটকেষ্ট এঁদের কাছেও আমার নাম ভাড়িয়ে কি সব বলেছে।
এক তরুণ কর্মী চিঠির তাড়া বাঁধছিলেন। ফিক করে হেসে বললেন, কত টাকা ধার নিয়েছে বটোদা?
পোস্টমাস্টার কিছু বলার আগেই কর্নেল বললেন, নাহ। টাকা ধার নেননি। নেহাত নিজের পরিচয় দিয়েছেন। ধার চাইলেই বা দেব কেন? কিন্তু কে এই ভদ্রলোক?
অনিলবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, ওকে ভদ্রলোক বলছেন? নাম্বার ওয়ান ঠক। আমার নাম ভঁড়িয়ে কত লোককে ঠকিয়েছে জানেন? এই অফিসেই একসময় পোস্টম্যান ছিল বটকেষ্ট। এর চিঠি তাকে, তার চিঠি ওকে করে গণ্ডগোল বাধাত। শেষে মানিঅর্ডারের টাকা মেরে ধরা পড়ল। ছমাস জেল হয়েছিল। জানেন?
এখন কোথায় থাকেন উনি?
অনিলবাবু খাক শব্দ হাসলেন, ও শচীন। বটকেষ্ট কোথায় থাকে জানো?
শচীনবাবু বললেন, পাটোয়ারজির গদিতে খাতা লেখে। গদির লাগোয়া একটা ঘরে থাকে। পাটোয়ারিজি ঘুঘু লোক।
বলো কি! জেনেশুনেও পাটোয়ারিজি ওকে কাজ দিয়েছেন?
রতনে রতন চেনে। বলে শচীনবাবু খি খি করে হেসে উঠলেন।
কর্নেল পোস্টমাস্টারকে নমস্কার করে বেরিয়ে এলেন। জিপের কাছে গিয়ে অলোম, বাপস! কত কি বেরিয়ে এল ঝুলি থেকে। মাথা ভো ভো করছে। কিন্তু দয়াময়ী সাঁতরা কি আপনার মক্কেল?
নাহ্। মকেল-টক্কেল নন। আমারই নেহাত কৌতূহল। অনুসন্ধিৎসা বলতে পারে।
শব্দছক ও স্বস্তিকা–
কর্নেল হাসলেন। এতদিনে বুঝলাম তৎকালীন পোস্টম্যান বটকৃষ্ণবাবু ইচ্ছে করেই রং ডেলিভারি দিয়েছিলেন দয়াময়ীকে। খামের মধ্যে একটা কাগজে স্বস্তিকা চিহ্নের তলায় ওই মকর, কচ্ছপ এবং রপট শব্দছক আঁকা ছিল।
বুঝলাম। কিন্তু খামের ওপর নাম-ঠিকানা ছিল তো?
ছিল। প্রসন্নকুমার রায়। অথচ বাংলোর চৌকিদার কৃপানাথ যা বলল, তাতে মনে হয়, প্রসন্নবাবু বছর আগে ভীমগড় ছেড়ে কলকাতাবাসী হয়েছিলেন। জিপে উঠে কর্নেল রহমতকে বললেন, পাটোয়ারিজির গদি চেনো রহমত?
রহমত স্টার্ট দিয়ে বলল, জরুর কর্নিলসাব। সুন্দর সিং পাটোয়ারিজিকে এ মুলুকে সবাই চেনে। এখন নয়া টাউনশিপে কারবারি অফিস খুলেছেন। লেকিন তার গদি পুরানা বাজারে।
গদিতেই চলো আগে।
রহমত বিনীতভাবে বলল, পুরানা বাজারে ঘিঞ্জি গলি। গাড়ি ঢুকবে না। কর্নিলসাবকে একটু কষ্ট করে কয়েককদম হাঁটতে হবে।
ঠিক আছে।
জিপ সংকীর্ণ আঁকাবাঁকা রাস্তায় মিনিট পনের চলার পর ভিড়ভাট্টায় ভরা জরাজীর্ণ চেহারার একটা বাজার এলাকায় গিয়ে থামল। রহমত গদির হদিস দিল। কর্নেলকে অনুসরণ করলাম। সত্যিই ঘিঞ্জি গলি এবং খানাখন্দে ভরা পথ। জলকাদায় পাথরের ইট পিচ্ছিল হয়ে আছে। কিছুটা চলার পর একটা ফাঁকা চত্বর দেখা গেল। তার চারদিকে একতলা-দোতলা বাড়ি। দোকানপাটে ভিড় গিজ গিজ করছে। চত্বরে একদঙ্গল গরু-মোষ এবং ঘোড়া এখনই রাতের খাওয়া সেরে নিচ্ছে। যে গাড়িগুলো তারা টেনে এনেছে, সেগুলো কোন্ পথে ঢুকেছে খুঁজে পেলাম না। সবে বিদ্যুতের আলো জ্বলে উঠেছে। কারণ আকাশে ঘন মেঘ নীচের নৈসর্গিক আলো শুষে নিয়েছে।– পাটোয়ারিজির গদি খুঁজে পাওয়া গেল। গদিতে যে অবাঙালি ভদ্রলোক দোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বসেছিলেন, তিনি পাটোয়ারিজির এক ভাতিজা। তার কাছে জানা গেল, বটকৃষ্ণবাবু কারবারি কাজে কলকাতা গেছেন। এখনও ফেরেননি।