অবশেষে একটা মাঝারি গড়নের প্রপাতের কাছে জিপ থেমেছিল এবং কর্নেল উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। বুঝেছিলাম সেই অর্কিডের খোঁজেই গেলেন। আকাশ কখনও নিজেকে ঘন মেঘে ঢাকছে। কখনও মেঘ সরিয়ে ঝলমলে রোদ্দুর ছড়াচ্ছে। বৃষ্টি ছিল না। রহমত খৈনি ডলতে ডলতে তার সামরিক জীবনের গল্প শোনাচ্ছিল। তাতে রঙ চড়ানো স্বাভাবিক। আমি কখনও শুনছিলাম, কখনও অন্যমনস্ক। শব্দছকের তিনটি শব্দ মকর, কচ্ছপ এবং রপট, গুপ্তযুগের মন্দির স্থাপত্যে স্বস্তিকা চিহ্ন এবং পোস্টমাস্টার অনিল কুমার সাঁতরা আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। শেষে ভাবলাম, ব্যাপারটা আমাকে নিয়ে কর্নেলের একটা কৌতুক ছাড়া কিছু নয়।
প্রপাতের গর্জনে রহমতের কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না। তাতে আমি হিন্দি, উর্দু তত বুঝি না। সে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছিল। একসময় সে ঈষৎ উদ্বেগে বলল, এই জঙ্গলে জন্তু জানোয়ার আছে। তবে তার ভয় বুনো হাতির পাল সম্পর্কে। হাতিদের সর্দার নাকি খামখেয়ালি হয়। কার্নিলসাব কি কোথাও তার পাল্লায় পড়ে আটকে গেছেন? না কর্নিলসাব মিলিটারির লোক। তিনি হাতির সর্দারকে ফাঁকি দিতে পারবেন। লেকিন বহত দের হো জায়েগা। বৃষ্টি এসে গেলে ধস্ ছাড়ারও ভয় আছে।
প্রায় দেড়টা নাগাদ কর্নেল ফিরলেন। হাতে কয়েকটা অর্কিডের চারা। বললেন, ফুল দেখলে তুমি অবাক হতে জয়ন্ত। কিন্তু তুমি তো জানো, আমি কখনও ফুল ছিড়ি না। সেটা পাপ গণ্য করি। হুঁ, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতাম। নিয়ে যাইনি তার কারণ জায়গাটা ভীষণ দুর্গম। তোমাকে নিয়ে সমস্যা হত।
আমাদের ভাগ্য ভাল। বৃষ্টি নামল বাংলোয় ফেরার পর। রহমত বৃষ্টির মধ্যে জিপ নিয়ে ভীমগড়ে ফিরে গেল। বলে গেল, সে খেয়েদেয়েই ফিরবে। বাং লোর প্রবীণ চৌকিদারকামরাঁধুনি কিরপানাথ কৃপানাথ চমৎকার বাঁধে। দেরিতে হলেও বৃষ্টির পরিবেশে এবং খিদের দরুন খাওয়াটা ছিল তৃপ্তিদায়ক। খেতে খেতে কর্নেল হিন্দিতে কৃপানাথকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো ভীমগড়ের পুরনো লোক। তুমি পোস্টমাস্টার অনিলবাবুকে চেনো?
কৃপানাথ বলল, হ্যাঁ স্যার। চিনব না কেন? ওঁকে সবাই চেনে। আজকাল চিঠি লেখার খুব রেওয়াজ হয়েছে। আগের দিনে এত বেশি ছিল না। যে লেখাপড়া জানে না, সে-ও নানা জায়গায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে চিঠি পাঠায়। চিঠি লিখে দেওয়ার লোকও পোস্টাপিসে আছে। মানিঅর্ডার ফরম লেখা, ইংরেজিতে টাইপ করে দরখাস্ত পাঠানোর জন্যও লোক আছে। তবে পোস্টমাস্টারের কথা বলেছেন। ওঁরা ভীমগড়ের বড় ব্যবসায়ী পরিবার। বাঙালি বাজারের একচেটিয়া কারবারি। অনিলবাবু ব্যবসা ছেড়ে কেন যে চাকরিতে ঢুকলেন বুঝি না।
জিজ্ঞেস করলাম, বাঙালিবাজার নামে আলাদা বাজার আছে নাকি?
আছে স্যার। আমার ছোটবেলায় বাঙালি জমিদার ছিলেন। তিনিই ভীমগতে বাজার, হাইস্কুল, লাইব্রেরি, দেব-দেবীর মন্দির কত কি করেছিলেন। এখন ওঁরা কলকাতা চলে গেছে। একটু দ্বিধার সঙ্গে কৃপানাথ ফের বলল, সাঁতরাবাবুদের অত্যাচারেই চলে গিয়েছিলেন জমিদার রায়বাবুরা। কি নিয়ে মামলা-মোকর্দমা হয়েছিল শুনেছি।
কর্নেল বললেন, তুমি তাহলে প্রসন্নকুমার রায়কে দেখেছ নিশ্চয়?
দেখেছি। তা বছর বিশেক আগে। উনি জমিদারবাড়ির ছোটহুজুর ছিলেন। বড় হুজুর নাকি সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে গিয়েছিলেন।
জমিদারবাড়িটা তো এখনও আছে?
জঙ্গল আর খণ্ডহর হয়ে গেছে। এমন জঙ্গলে জায়গা যে, কেউ কিনতে রাজি হয় না। ছোটবেলায় শুনেছি লোকে বলত কেল্লাবাড়ি। তিনদিক গড়খাই, একদিক নদী। গড়খাইয়ের ওপর একটা কাঠের সাঁকো ছিল। কবে ভেঙে গেছে। গড়খাইয়ের একখানে কারা পাথর ফেলেছিল। সেই পাথরের ওপর দিয়ে খণ্ডহরে যাওয়া যায়। কিন্তু যাবেই বা কে? কেনই বা যাবে? যদি যায় কেউ,
সে মুসহরবস্তির লোকেরা। ওরা শিকারি।
কর্নেল নিজেই বলেন, খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই। কিন্তু খেতে খেতে এইসব কথাবার্তা দিব্যি চালিয়ে গেলেন। খাওয়া শেষ হতে হতে বৃষ্টিটা থেমে গেল। মেঘ সরে রোদ্দুর ফুটল। রহমত জিপ নিয়ে এসে গেল। আমার ভাতঘুমের অভ্যাস আছে। কিন্তু কর্নেল বাধ সাধলেন। প্রায় চারটে বাজে। ওঁর সঙ্গে বেরুতে হবে এবং চোখে হেসে বললেন, এবার অর্কিড নয় ডার্লিং। রহস্য।
জিপ ভীমগড়ের দিকে উত্রাইয়ের চিকন বৃষ্টিধোয়া পথে ছুটে চলল। কর্নেল বসতির কাছে পৌঁছে বললেন, রহমত, পোস্টঅফিসে যাব।
কৌতূহল চেপে রাখলাম। অফিস আদালত এলাকায় বড় রাস্তার ধারে ছিমছাম একতলা সাব পোস্ট অফিস। ইংরেজি এল প্যাটার্ন নতুন বাড়ি। বারান্দার এক কোণে একজন পেশাদার টাইপিস্ট আপন মনে টাইপ করে চলেছেন। ভিড় নেই। থাকারও কথা নয় এখন। কর্নেল কাউন্টারে এক কর্মচারীকে নিচু গলায় কিছু বললেন, সে মুখ ঘুরিয়ে ইশারায় কিছু দেখাল। কর্নেল ঢুকে গেলেন। আমিও ওঁকে অনুসরণ করলাম।
ভেতরে কোনার দিকে দেয়াল ঘেঁষে একটা চেয়ার টেবিল। চেয়ারে আন্দাজ পঁচিশ বছর বয়সী গাঁট্টাগোট্টা চেহারার এক যুবক বসে ফাঁইলে কিছু লিখছিলেন। কর্নেলকে দেখে ইংরেজিতে বললেন, দয়া করে বসুন মহাশয়। আপনাকে সাহায্য করতে পারি কি?
বাংলা অনুবাদে এই বাক্যদুটি দাঁড়ায়। তো বুঝলাম, কর্নেলকে উনি সায়েব। ভেবেছেন। কর্নেল বাংলায় বললেন, আপনিই কি পোস্টমাস্টার?