অন্য কাউকে দিয়ে সই করিয়েছে। ধূর্ত লোক।
কর্নেল জড়ানো গলায় বললেন, এখন আমাদের দরকার আর একটা চিঠি। তা হলেই কেল্লা ফতে। সেই চিঠিটা নিশ্চয় লেখা হয়েছিল এবং ১৩ জুলাই রাকেশের চিঠির সঙ্গে কলকাতা পৌঁছেছিল। আর বটকৃষ্ণবাবুর চিঠি পয়লা জুলাই লেখা। অথচ পৌঁছুল ১৪ দিন পরে–যখন বাচ্ছ কলকাতা থেকে চলে এসেছে। ভীমগড় ডাকঘরের ডেটস্ট্যাম্পে তারিখ ধেবড়ে গেছে। সে যাই হোক, বটকৃষ্ণবাবু কেন বাচ্চুকে পত্রপাঠ আসতে লিখেছিলন? চিঠিটা কলকাতা পৌঁছুতেই বা এত বেশি সময় লাগল কেন? দেরিতে পোস্ট করেছিলেন?
জবাব দেবার জন্য বটকৃষ্ণবাবু আর ইহলোকে নেই। ছেড়ে দিন।
নাহ্। তার হয়ে জবাব দেবার লোক আছে। দেখা যাক।
কর্নেলের নাক ডাকা শুরু হল। এইরকম ওঁর ঘুম। সামরিক জীবনে নাকি গাছের ডালেও ঘুমিয়ে পড়তেন।
পরদিন যথারীতি কর্নেলের ডাকে ঘুম ভাঙল। প্রকৃতিবিজ্ঞানী প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসেছেন। হাতে একগুচ্ছ অর্কিড়। সুপ্রভাত বলে সম্ভাষণ করে জানালেন, কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে পাথরের ফাঁকে এর খোঁজ পেয়েছেন।
হঠাৎ রাতের কথাটা মনে পড়ে গেল। বললাম, সেই তৃতীয় চিঠিটা খুজতেই কি কেল্লাবাড়ি গিয়েছিলেন?
কর্নেল হাসলেন। বাচ্চুকে মেরে তার লাশ যেখানে পোঁতা হয়েছিল, সেখানে মাটি নেই। লাইম কংক্রিটের চাবড়ার ভূপ। কাজেই খুনিকে কষ্ট করে খুঁড়তে হয়নি। চাবড়াগুলো সরালেই ফুট তিনেক গর্তের তলায় ঘরের মেঝে। সেখানে লাশ ঠেলে ঢুকিয়ে চাবড়াগুলো চাপিয়ে দিলেই পাকা কবর তৈরি হয়ে গেল। মুসহর বস্তির লোকেরা জাত শিকারি। কাজেই শেয়াল আসার চান্স নেই। শকুনও টের পাবে না। কারণ সেই কবরের ওপর ভাঙা ছাদের অংশ ঝুলছে। হ্যাঁ, মুসহররা কুকুর পোষে। কিন্তু ওদিকে গড়খাইয়ে এখন গভীর জল। কাজেই লাশ কোনও দিনই আবিষ্কৃত হত না।
আহ্। চিঠিটা–
হ্যাঁ। দুটো চিঠি আস্ত রেখে নিজেরটা বুদ্ধিমান খুনি হাতিয়ে নিয়েছিল। যাক শত্রু পরে পরে। কিন্তু তখন অন্ধকার রাত। হয়তো বৃষ্টিও পড়ছিল। চিঠিটা সাততাড়াতাড়ি ছিঁড়ে কুচি কুচি করে কবরের চাবড়ার তলায় খুঁজে রেখেছিল। ওখানে বৃষ্টি বাঁচানো ভাঙা ছাদ আছে। কাজেই ভেজেনি। কিন্তু আমার অবাক লাগছে, পুলিশ কবর খুঁড়ে লাশ বের করল। অথচ নীল রঙের কুচিগুলো চোখে পড়ল না কেন? পুলিশ রুটিন ওয়ার্কে পটু। তাই অত লক্ষ্য করেনি। বলে কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে রুমালে জড়ানো চিঠির কুচিগুলো বের করলেন। জয়ন্ত। বাথরুমে যাওয়ার আগে ফ্যান বন্ধ করে যাও। এগুলো উড়ে যাবে। দেখা যাক, কতটা মেলাতে পারি।
ফ্যান বন্ধ করে বাথরুমে গেলাম। এরপর ফিরে এসে দেখলাম, কর্নেল তখনও নীলচে কুচিগুলো মেলাচ্ছেন। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম, একেকটা কুচিতে একটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত হরফ পড়া যাচ্ছে। একটু পরে কৃপানাথ কফি দিয়ে গেল। কর্নেল কফির পেয়ালা তুলে বললেন, এনাফ। বরাবর দেখে আসছি, খুনি নিজের অজ্ঞাতসারে এমন কিছু চিহ্ন রেখে যায়, যা তাকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করে। হয়তো ব্যস্ততা কিংবা অতিবুদ্ধি, অথবা আতঙ্ক।
কার চিঠি বুঝতে পারছেন?
কর্নেল চারটে কুচির দিকে আঙুল রাখলেন। একটাতে বৃহ দ্বিতীয়টাতে ব তৃতীয়টাতে শব্দা এবং চতুর্থটাতে শুধু ন। কর্নেল হাসলেন। কিছু বুঝলে?
নড়ে বসলাম। মাই গুডনেস। বৃহৎ বঙ্গীয় শব্দাভিধান। তার মানে, এই চিঠি অনিলবাবু লিখেছিলেন। কর্নেল, আপনি কি বলতে চান অনিলবাবুই দু-দুটো খুন করেছেন?
চুপ। রহমত আসবে জিপ নিয়ে। আমরা এখনই বেরুব।
১০. উপসংহার
রহমতের জিপ সবে পোর্টিকোর তলায় ঢুকছে, এমন সময় মিঃ পাণ্ডের পুলিশ জিপও এসে হাজির। পাণ্ডেকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। বারান্দায় উঠে ব্যস্তভাবে বললেন, য়ু আর রাইট কর্নেল সরকার। ডাকঘরের বারান্দায় যে লোকটা টাইপ করে, তার নাম বদ্রিনাথ প্রসাদ। জেরার চোটে কবুল করেছে, রাকেশের নামে চিঠিটা সে অনিলবাবুর অনুরোধে টাইপ করেছিল। কাজেই অনিল সাঁতরাকে শেষরাতে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদিকে রাকেশ শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছে, বাচ্ছ তাকে বলেছিল অনিল চোরাই মালের জিম্মাদার। তারা দুজনে মিলে মালটা উদ্ধার করেছে। রাকেশ যেন পাটোয়ারিজির সঙ্গে কথা বলে রাখে। রাতেই তারা মাল নিয়ে যাবে। কিন্তু কথামতো বাচ্চু এবং অনিল সে রাতে যায়নি। পরদিন সকালে অনিল একা রাকেশকে সঙ্গে নিয়ে পাটোয়ারিজির কাছে কথা বলতে যায়। পাটোয়ারিজি বলেন, মাল না দেখে দরদাম হবে না। অনিল কিন্তু আর যায়নি। কেন যায়নি, তা ওকে জেরা করে জেনে নেওয়ার চেষ্টা চলেছে। দেখা যাক।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ফেলে বললেন, সকালে মুসহর বস্তিতে গিয়েছিলাম। ভারুয়া নামে একটা লোক বলল, কিছুদিন থেকে অনিল সাঁতরাকে সে কেল্লাবাড়িতে ঘুরঘুর করতে দেখত। আর যখনই অনিল সেখানে যেত, বটোবাবু তাকে আড়াল থেকে ফলো করত। ভারুয়া জাত শিকারি। তার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, তার দৃষ্টিশক্তি তীক্ষ্ণ। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, বটোবাবুর ফলো। করে বেড়ানো অনিলের চোখে পড়ে থাকবে। তাই সে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। কর্নেল আমার দিকে ঘুরলেন। হাওড়া স্টেশনে বটোবাবুর শেষ সংলাপে আরও একটি মাত্রা যোগ করা চলে। উনি বলেছিলেন, কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভারি অদ্ভুত তো। তার মানে, নবকুমারবাবু কলকাতা এসেছে। কাজেই তার খুন হওয়া সম্ভব নয়। এরপর ভারি অদ্ভুত তো কথাটার মানে আরও অর্থবহ হচ্ছে, ছেলের বাবাকে খুন করা ভারি অদ্ভুত। যাই হোক, বটোবাবু কলকাতা ছুটেছিলেন। বাচ্চুকে জানাতে যে, অনিল কেল্লাবাড়িতে বড্ড বেশি ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে। কারণ বাচ্চু তার চিঠিতে সাড়া দেয়নি।