কানে আসছিল। তুমি তো জানো জয়ন্ত আমার শ্রবণেন্দ্রিয় বিচ্ছিরি রকমের প্রখর। শুনতে না চাইলেও শোনা হয়ে যায়।
বাইরে কোথাও ট্রেনে গেলে কর্নেল কুপে পছন্দ করেন। এবারকার যাত্রা ভীমগড়ে এবং সেখানে নাকি এক দুর্লভ প্রজাতির অর্কিড এই বর্ষাকালে অবিশ্বাস্য রকমের ফুল ফোঁটায়, যা নাকি ময়ূরের পেখমের মতো। কর্নেল তার কি একটা লাতিন নামও বলেছিলেন, ভুলে গেছি। তবে এবার দেশের সর্বত্র বর্ষার যা বিক্রম শুনছি, ভ্রমণ আমার কাছে কতখানি আনন্দদায়ক হবে সংশয় ছিল।
ট্রেন ছাড়ার পর হাসতে হাসতে বললাম, ভদ্রলোক আপনার চেয়ে বাতিকগ্রস্ত। ওঁকে ভীষণ ভড়কে দিয়েছি। ভীমগড়ে দুদিন আগে গোপন হত্যাকাণ্ড এবং আপনি চলেছেন সেই রহস্য ফাঁস করতে।
প্রকৃতিবিজ্ঞানী টুপি খুলে রেখে টাকে হাত বুলোচ্ছিলেন। চুরুট ধরিয়ে বললেন, । রহস্য তো বটেই।
কি রহস্য?
অনিল কুমার সাঁতরার শেষ সংলাপটা। বলে কর্নেল আবার আওড়ালেন, কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভারি অদ্ভুত তো।
আশ্চর্য! আপনি দেখছি আপনার এক গুণমুগ্ধ ফ্যানের কথাতেও রহস্য আবিষ্কার করে ফেললেন! কর্নেল, এরপর আপনি আমার কথাতেও
ডার্লিং! ভদ্রলোকের ওই কথাটা আমার কানে বিধছে।
হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, ঠিক আছে বস্। ভীমগড়ে গিয়ে পোস্টমাস্টার ভদ্রলোকের সঙ্গে নিরিবিলি কথা বললেন। তবে আমি এসবে নেই। না আপনার কোন দুর্লভ প্রজাতি অর্কিডে, না অনিলকুমার সাঁতরার ব্যাপারে। আপনি বলেছেন, কোন টিলার ওপরে বাংলোয় বসে বৃষ্টির রূপ দর্শন নাকি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হবে। ব্যস্!
টিলাটাকে স্থানীয় লোকেরা বলে ভীমের গদা।
সে কি! পাথরের ন্যাড়া টিলার ওপর বাংলো?
কর্নেল হাসলেন। না। দ্বাপর যুগের গদার এই কলিযুগে কি অবস্থা হবে। চিন্তা করো। তাতে বনদফতরের মালীদের হাত পড়েছে। তাছাড়া এখন বর্ষাকাল। বলে কর্নেল সেই পত্রিকাটি খুললেন এবং ফের পোস্টমাস্টারের শেষ সংলাপ আওড়ালেন, কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভারি আশ্চর্য তো!
বিরক্ত হয়ে কিটব্যাগ খুলে একটা গোয়েন্দা উপন্যাস বের করলাম।
একটু পরে শুনি, কর্নেল বলছেন, নাঃ। এর আগে একটা কথা ছিল। কী যেন কথাটা?
বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে বললাম, ব্যাপারটা কি খুলে বলুন তো?
মনে পড়েছে। শব্দ জুড়ে বাক্য, বাক্য জুড়ে সন্দর্ভ। ইংরেজিতে বলে ডিসকোর্স। কর্নেল আপনমনে বললেন, প্রায় একটা সন্দর্ভের সূচনা। প্রথম বাক্যটি ছিল, হুঁ। বুঝেছি। পরের দুটি বাক্য কিন্তু তা কি করে সম্ভব? আশ্চর্য তো! তার মানে, ভীমগড়ের পোস্টমাস্টার অনিলকুমার সাঁতরা, যিনি সেখানে তিনপুরুষ ধরে বাসিন্দা, তিনি একটি কল্পিত গোপন হত্যাকাণ্ডের কথা শুনে তিনটি বাক্য উচ্চারণ করলেন। মাই গুডনেস!
কর্নেলকে নড়ে বসতে দেখে বললাম, কি?
স্বস্তিকা।
তার মানে?
নাগমিথুন।
ওঃ!
জয়ন্ত। গুপ্তযুগে নাগমিথুনের প্রতীক ছিল স্বস্তিকা চিহ্ন, সে যুগের মন্দির স্থাপত্যের শৈলীতে স্বতিকা চিহ্ন ছিল একটি আবশ্যিক অংশ।
হঠাৎ গুপ্তযুগের স্থাপত্য এবং স্বস্তিকা নিয়ে পড়লেন কেন?
কর্নেল বৃষ্টিরোধী নেভি ব্লু রঙের জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে একটা ভঁজকরা কাগজ খুলে আমার হাতে দিলেন। মুখে মিটমিটে হাসি। দেখি কাগজটার মাথায় স্বস্তিকা এবং নিচে একটা শব্দছক আঁকা আছে। যেদিক থেকে পড়া যাক, শব্দগুলো একই থাকে। শব্দছকটা এই
ম ক র
ক চ্ছ প
র প ট
বললাম, এ আবার কি? কর্নেল কাগজটা আমার হাত থেকে নিয়ে ভাঁজ করে ভেতর পকেটে ঢুকিয়ে শুধু বললেন, রহস্য। তবে শব্দরহস্য। যাকে বলে ধাঁধা।
০২. ভূতের চেয়ে অদ্ভুত
একটা মজার শব্দছককে কেনই বা কর্নেল ধাঁধা বললেন এবং গুপ্তযুগের মন্দির স্থাপত্যের স্বস্তিকা চিহ্নকে তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন, উপরন্তু অনিলকুমার সাঁতরার কথাগুলি নিয়ে মাথা ঘামালেন, উনিই জানেন। তবে ব্যাপারটা আমাকে চিন্তিত করেছিল। তার কারণ এই বর্ষা-বাদলার মরশুমে কোনও রহস্যটহস্যের পেছনে ছোটাছুটি করে বেড়াবেন কর্নেল এবং আমাকেও বেশ ভোগাবেন মনে হচ্ছিল।
তাহলে কি ময়ূরের পেখমের মতো ফুলফোঁটানো অর্কিড দেখতে যাওয়া ওঁর নেহাত একটা ছুতো? ভীমের গদা নামক টিলার সুদৃশ্য বন বাংলোয় পৌঁছে অবশ্য উদ্বেগটা কেটে গিয়েছিল। সেখানে থেকে একটা সুবিস্তীর্ণ সংরক্ষিত জঙ্গল শুরু। সমৃদ্ধ পুরনো জনপদ ভীমগড় মোটামুটি সমতল একটা পাহাড়ি উপত্যকায় অবস্থিত। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটা ছোট্ট নদী। কিন্তু এই বর্ষায় সত্যিই যে ভীমা ভয়ঙ্করী। ফরেস্ট বাংলোর দূরত্ব ভীমগড় থেকে প্রায় এক কিমি। তবে কর্নেলের স্নেহভাজন বন দফতরের অফিসার হরদেব সিংহের একটি জিপ আমাদের সেবার জন্য তৈরি থাকায় কোনও অসুবিধে হয়নি। জিপচালক রহমতের গোঁফ এবং তাগড়াই চেহারা আপাতদৃষ্টি ভীতিপ্রদ হলেও সে খুব অমায়িক এবং সজ্জন লোক। একসময় প্রতিরক্ষা দফতরে চাকরি করত। কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চলে দুর্গম তুষারঢাকা পথে সামরিক যানবাহন চালানোর অভিজ্ঞতা তার আছে। কর্নেলকে সে বেজায় সমীহ করে এবং দেখামাত্র সামরিক সেলাম ঠোকে।
বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ রহমত কর্নেলের নির্দেশে জঙ্গলের পথে জিপ ছুটিয়েছিল। সে সাংঘাতিক পথের বর্ণনা দিচ্ছি না। দেওয়া যায় না বলেই। তাছাড়া সেটাকে পথও বলা যায় না। টুকরো টুকরো পাথরের চাই এবং হঠাৎ হঠাৎ বাঁক। কখনও বর্ষার ধস ছেড়ে পড়া গাছপালা ঝোপঝাড় জিপের গতি রোধ করছিল। রহমত জিপ থামিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু কর্নেলের বা আমার একাজে সাহায্য নেওয়ার পাত্র নয় সে। তার কথা, আরামসে বৈঠিয়ে সাব! ইয়ে তো মামুলি কাম হ্যাঁয়। সেইসঙ্গে লাদাখে বড় বড় তুষারঢাকা পাথর সরিয়ে তার জিপ চালানোর অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিল সে।