দয়াময়ী বললেন, আপনাকে আগে বলা উচিত, বাচ্চুর মৃত্যুতে আমি দুঃখিত হইনি। দুধ দিয়ে কালসাপ পুষেছিলাম। ও আমার জীবনে কাটার মতো বিধত। এবার আমি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।
কর্নেল বললেন, আপনি আমাকে ওর সম্পর্কে কিছু জানাননি।
ইচ্ছে করেই জানাইনি। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে ওই খামটা সম্পর্কে আমার কৌতূহল ছিল তাই ভেবেছিলাম, আপনিই এই অদ্ভুত ধাঁধার জট ছাড়াতে পারবেন।
ছাড়িয়েছি। কিন্তু আগে প্রশ্নের উত্তর দিন। বাচ্চু কবে কলকাতা থেকে এখানে এসেছিল?
দয়াময়ী একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ও মাঝে মাঝে কিছু না জানিয়ে উধাও হয়ে যেত। গত ১৩ জুলাই দুপুরে খেয়ে বেরিয়ে যায়। তারপর আর পাত্তা পাইনি। হঠাৎ আজ এখান থেকে পুলিশ ট্রাঙ্ককল করে জানাল–
আপনার দেবর নবকুমারবাবু আপনার কাছে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। রায়বাবুর সঙ্গে মামলা মিটমাটের জন্য বলছিল। আমি বলেছি, ভেবে দেখি।
বটকৃষ্ণবাবু কি আপনার কাছে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। বটো প্রায় যেত। বাচ্চুর সঙ্গে ওর ভাব ছিল। আমি বটোকে পাত্তা দিতাম না। বটোর দুমুখো স্বভাব ছিল।
নবকুমারবাবু আপনার ওখানে থাকার সময় কি বটকৃষ্ণবাবু গিয়েছিলেন?
না। নব বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরে বটো গিয়েছিল।
তা হলে বটকৃষ্ণবাবু নবকুমারবাবুকে আপনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে থাকবেন। কিংবা নবকুমারবাবু আছেন জেনে বাইরে উনি অপেক্ষা করছিলেন। যাই হোক, বটকৃষ্ণবাবু আপনাকে কি বলেছিলেন?
বাচ্চুর কথা জিজ্ঞেস করল। বললাম, বাচ্চু নেই। বটো বেহায়া লোক ছিল। খেতে চাইল। খেতে দিলাম। খেয়েদেয়ে চলে গেল। দশটা টাকা চাইল। তাও দিলাম।
বাচ্চু যাওয়ার আগে টাকা চেয়েছিল আপনার কাছে?
পাঁচশো টাকা ধার চেয়েছিল। ধার চাওয়াতে আমার রাগ হয়েছিল। অনেক সাধাসাধির পর তিনশো টাকা দিয়েছিলাম।
অনিলবাবুর সঙ্গে তো আপনার সম্পর্ক ভাল?
অনিল ওর বাবা আর দাদার মতো কুচুটে নয়। আমাকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করে। আমি এলে অনিল আর ওর বউ খোঁজখবর নেয়। অনিল বাচ্চুর বন্ধু। হলেও বাচ্চুর মতো খামখেয়ালি বা দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে নয়। বাচ্চুকে নিয়ে আমার ঝামেলার শেষ ছিল না কর্নেলসায়েব।
কিন্তু গতমাস থেকে অনিলবাবুর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি আগের মতো আছে?
দয়াময়ীর চোখে চমক লক্ষ্য করলাম। অনিল কিছু বলছিল নাকি?
হ্যাঁ। গতমাসে এখানে এসে আপনি শাসিয়েছিলেন ওকে।
ওকে শাসাব কেন? ওর বাবাকে আর দাদাকে শাসিয়েছিলাম। শাসাব না? আমার ঘরের তালা ভেঙে জিনিসপত্র তছনছ করবে, আর আমি চুপ করে থাকব?
পুলিশকে জানাননি কেন?
দয়াময়ী আস্তে বললেন, কিছু চুরি যায়নি, তাই। কিন্তু ঘরের ভেতরটা লণ্ডভণ্ড করে রেখেছিল।
চোর কি কিছু খুঁজেছিল বলে আপনার মনে হয়?
পরে মনে হয়েছে।
আপনার ঘরে এমন কি থাকতে পারে যে চোর তা খুঁজবে?
এবাড়িতে তেমন দামি কিছু রাখিনি। শুধু কিছু আসবাবপত্র, বিছানা আর রান্নাবান্নার জিনিস। পার্টিশন করা বাড়ি। অন্য পাশে অনিল থাকে। তাই অনিলের গায়ে লেগে থাকতে পারে। না–আমি অনিলের নাম ধরে শাসাইনি।
নবকুমারবাবু বলছিলেন, অনিল তার ঘর থেকে কিছু দলিলপত্রের ফাইল চুরি করে আপনাকে দিয়েছে। তাই অনিলকে তিনি পৃথগন্ন করে দিয়েছেন।
দয়াময়ী বাঁকা মুখে বললেন, আমার স্বামীর দলিলপত্রের ফাইল। নব তা লুকিয়ে রাখবে, চাইলে দেবে না বাহ্। কেল্লাবাড়ির বড় রায়বাবুর কাছে আমার স্বামী গঙ্গা-যমুনা নামে দুটো পুকুর আর মাঝখানের জমিটা পুরো কিনেছিলেন। ওতে নবর শেয়ার নেই। সেই দলিলপত্র নব লুকিয়ে রেখেছিল। কাজেই আমি কোনও অন্যায় করিনি। বাচ্চু অনিলের বন্ধু। বাচ্চু অনিলকে বলেকয়ে ফাইলটা হাতাতে রাজি করিয়েছিল। তা অনিলকে বুঝি সেইজন্য টাকাকড়ি দিইনি? বলুক তো আমার সামনে।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আপনি ট্রেনজার্নিতে ক্লান্ত। আর একটা প্রশ্ন করব।
যত খুশি প্রশ্ন করুন।
শব্দছকের কাগজটা কি আপনি কখনো বাচ্চুকে দেখিয়েছিলেন?
দয়াময়ী একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, বছর তিনেক আগের ব্যাপার। তখন আমি এখানেই থাকি। খামটা ভুল করে ছিড়িনি–তা আপনাকে কলকাতায় বলেছি, কৌতূহলী হয়েই ছিঁড়েছিলাম। কিছু বুঝতে না পেরে টেবিলের ড্রয়ারেই রেখেছিলাম। তারপর হঠাৎ মনে পড়েছিল, আমার স্বামী বলতেন গঙ্গা-যমুনার তলায় নাকি কোন আমলের যক্ষের ধন পোঁতা আছে শুনেছি। মনে পড়ার পরই খামটা আলমারির লকারে লুকিয়ে রাখি। এখন বাচ্চু ওটা তার মধ্যে দেখে ফেলতেও পারে। কেল্লাবাড়িতে যক্ষের ধনের গুজব ভীমগড়ে বরাবরই চালু আছে।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। ঠিক আছে। আপনি বিশ্রাম করুন গিয়ে। দরকার হলে যোগাযোগ করব।
পাণ্ডে বললেন, মিসেস সাঁতরা। আপনি গাড়িতে বসুন। জাস্ট এ মিনিট।
বলে উনি কর্নেলকে বারান্দার শেষ প্রান্তে ডেকে নিয়ে গেলেন। চাপা স্বরে কিছু কথাবার্তা হল। তারপর উনি জিপে গিয়ে বসলেন। স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এতক্ষণে দেখতে পেলাম, জিপের পেছনের খোঁদলে কজন সশস্ত্র কনস্টেবল বসে আছে।
কর্নেল বললেন, সওয়া এগারোটা বাজে। চলো, শুয়ে পড়া যাক।
ঘরে ঢুকে বললাম, সত্যিই দজ্জাল মহিলা। বান্ধব পাঠাগারের ইন্দুবাবু ঠিকই বলছিলেন।
কর্নেল বাথরুমে গিয়ে রাতের পোশাক পরে এলেন। তারপর বিছানায় শুয়ে বললেন, সুখবর ডার্লিং। আশা করি তোমার সুনিদ্রা হবে। রাকেশ শর্মা জেরার মুখে কবুল করেছে, ১৪ জুলাই সন্ধ্যার একটু আগে সে এবং বাচ্চু কেল্লাবাড়ির সেই ঢিবিতে বসে কথা বলেছিল। কথা একটা চোরাই জিনিস নিয়ে। খুব দামি জিনিস। পাটোয়ারিজি দেখলেই নাকি কিনে নেবেন। তারপর রাকেশ গিয়ে মালিকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আসে। কিন্তু বাচ্চুর আর খোঁজ পায়নি। বাচ্চু রাকেশের বাড়িতে উঠেছিল, তাও সত্য। তো রাকেশ বরাবর দেখেছে, বাচ্চু ওইরকম খামখেয়ালি। তাই তার নিপাত্তা হয়ে যাওয়া নিয়ে মাথা ঘামায়নি। আর হ্যাঁ, রাকেশ বলেছে যে, বাচ্চুকে কোনও চিঠি লেখেনি। ইনল্যান্ড লেটারটা তাকে দেখিয়েছে পুলিশ। ইংরেজিতে টাইপ করা চিঠি। তলার সইটা রাকেশের সইয়ের সঙ্গে মেলেনি।