হ্যাঁ। অনিলের সঙ্গে আসত-টাসত। আমি ওকে পছন্দ করতাম না স্যার। তবে সাঁতরাবাড়ির বড়বাবুর স্ত্রী ওকে পোয্যপুত্র নিয়েছিলেন। তিনিও এক দজ্জাল মহিলা স্যার। এখন কলকাতায় থাকেন। মাঝে মাঝে আসেন।
বাচ্চুবাবু গুণ্ডামি করে বেড়াতেন জেনেও তাকে পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা?
ইন্দুবাবু চাপা স্বরে বললেন, ওঁর দেওর–মানে অনিলের বাবার অত্যাচারে। বাচ্চু না থাকলে অনিলের বাবা নব তার বউদিকে প্রপার্টির ন্যায্য শেয়ার দিত না। পথে বসিয়ে ছাড়ত। নব স্যার হাড়ে হাড়ে বজ্জাত। টাকা ওর ধ্যানজ্ঞান। কিন্তু অনিল ওঁর ছেলে হয়েও উল্টো স্বভাবের। আবার দেখুন অনিলের দাদা সুনীল একেবারে বাবার মতো স্বভাব। অনিলকে বঞ্চিত করার তালে আছে। নব মারা পড়লেই দুভাইয়ে ঝামেলা বাধবে। তবে অনিলকে জব্দ করা কঠিন আছে।
কেন?
অনিল বাইরে বাইরে ভদ্র। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ফেরোসাস টাইপ। বলেই ইন্দুবাবু প্রসঙ্গ বদলালেন। চলুন স্যার। লাইব্রেরির কালেকশান দেখাই।
কর্নেল পকেট থেকে নেমকার্ড বের করে এঁকে দিয়ে বললেন, আমি চলি ইন্দুবাবু। এই ঠিকানায় বইয়ের লিফট পাঠাবেন। আমরা পক্ষে যতটা সম্ভব, তা কিনে পাঠিয়ে দেব। চলি। নমস্কার।
কর্নেল পা বাড়িয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। তারপর দাড়ি খামচে ধরে কি যেন ভাবলেন। ইন্দুবাবু নেমকার্ডটা খুঁটিয়ে পড়ছিলেন! কর্নেল ব্যস্তভাবে লাইব্রেরিতে ঢুকে টেবিলের ওপর রাখা সেই অভিধানটা তুলে নিলেন। তারপর শেষ দিককার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কি একটা চিরকুট হাত সাফাই করলেন। ইন্দুবাবু আমার পিছনে। তাই ব্যাপারটা আমার চোখে পড়ল।
ইন্দুবাবু বললে, খুব ভাল ডিকশনারি স্যার।
কর্নেল টেবিলে বইটা রেখে বললেন, বৃহৎ বঙ্গীয় শব্দাভিধান। আমি ভেবেছিলাম নিছক অভিধান। ঊনিশ শতকের পণ্ডিত রামবিনোদ ভট্টাচার্যের এই শব্দাভিধান এতদিন আউট অব প্রিন্ট ছিল। প্রকাশককে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।
বলেই উনি ব্যস্তভাবে বেরিয়ে এলেন। জিপে আমাকে উঠতে ইশারা করলেন। তারপর উনি উঠে বললেন, রহমত। ফরেস্ট বাংলোয় ফিরব। আজ আর তোমাকে কষ্ট দেব না। কাল সকাল নটায় তুমি জিপ নিয়ে এসো যেন।
বাংলোয় আমাদের পৌঁছে দিয়ে রহমত চলে গেল। কর্নেল কৃপানাথকে কফি আনতে বলে বারান্দায় বসলেন। জিজ্ঞেস করলাম, অভিধান খুলে আপনার হাতসাফাই দেখে নিয়েছি।
কর্নেল পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে দিলেন। দেখলাম, কলকাতার এক নামী পুস্তক বিক্রেতার দোকানের ক্যাশমেমো। তারিখে ১৩ জুলাই। মেমোতে ক্রেতার নাম নেই। ১০ শতাংশ কমিশন বাদ দিয়ে ১৮০ টাকা দাম নেওয়া হয়েছে।
কর্নেল বললেন, কি বুঝলে বলো জয়ন্ত?
বইটা ভি পি পি-তে আসেনি। অনিলবাবু মিথ্যা বললেন কেন?
মেমোটা যে পাতায় ছিল, সেই পাতায় রপট শব্দটা আছে। পাশে টিক দেওয়া।
তা হলে শব্দছকটা–
হ্যাঁ। অনিলবাবু জাননে। জানার কারণ ছিল প্রসন্ন রায়ের নামে ডাকে আসা চিঠি। প্রসন্নবাবু তখন কলকাতাবাসী। এদিকে তখন পোস্টম্যান ছিলেন বটকৃষ্ণবাবু। তিনি পোস্ট মাস্টারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবেন। আমার যুক্তিসঙ্গত অনুমান, চিঠিটা কৌতূহলী হয়ে খুলেছিলেন অনিলবাবুই। তারপর বটকৃষ্ণবাবুকে কলকাতায় প্রসন্নবাবুর ঠিকানায় রিডাইরেক্ট করতে বলেন। ঠিকানার ওপর লাল ডটপেনে কাটা দাগ আছে। দেখাচ্ছি। বটকৃষ্ণবাবু রিডাইরেক্ট না করে দয়াময়ী দেবীর লেটারবক্সে রেখে আসেন। বটকৃষ্ণবাবুর মাথায় রহস্য তৈরির বাতিক ছিল, তা আমরা জেনেছি। কর্নেল হাসলেন। ভদ্রলোক পেটের দায়ে লোককে হয়তো চিট করতেন। কিন্তু ওঁর রহস্যবাতিক চাগিয়ে তুলেছিল সত্যসেবক পত্রিকায় লেখা তোমারই রঙ চড়ানো ক্রাইমস্টোরি। তোমার কলম বড্ড বেয়াড়া।
বিব্রতভাবে বললাম, ভ্যাট্। কি যে বলেন।
০৯. তৃতীয় চিঠি
রাতের খাওয়ার পর বারান্দায় বসেছিলাম। কর্নেল পাহাড়ি অর্কিড নিয়ে বকবক করছিলেন। আমি বৃষ্টির আশা করছিলাম। রাতের বৃষ্টির সৌন্দর্য এমন করে কখনও বুঝিনি। কিন্তু আকাশে মেঘ নেই। নক্ষত্রমালায় এ রাত আজ অন্য সাজে সেজেছে।
শুয়ে পড়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু কর্নেল বললেন, আর একটু বসো জয়ন্ত। আশা করছি, আজ রাতেই রহস্যের শেষটুকু ফঁস হয়ে যাবে।
অগত্যা বসতে হল। বললাম, ফাস হতে আর বাকি কি আছে? খুনি রাকেশ শর্মা, সেটা তো স্পষ্ট। অচিন্ত্য যেভাবে হোক, শব্দছকের ধাঁধা ছাড়িয়ে স্বস্তিকা উদ্ধার করেছিল। তাকে মেরে স্বস্তিকা হাতিয়ে রাকেশ তার লাশ পুঁতে রেখেছিল। অতি উৎসাহী বটকৃষ্ণবাবু কলকাতা থেকে আমাদের সঙ্গে ফিরে কেল্লাবাড়িতে গিয়ে নিশ্চয় লাশ পুঁতে রাখার চিহ্ন দেখেছিলেন। তাই ভোরবেলা লাশ খুঁড়ে বের করতে–
ওই দেখ। সম্ভবত মিঃ পাণ্ডের জিপ আসছে।
উত্রাই পথের নিচে আলোর ঝলক দেখতে পেলাম। জিপ গেটের কাছে এসে হর্ন দিলে কৃপানাথ দৌড়ে গিয়ে তালা খুলে গেট ফাঁক করল। জিপটা এসে পোর্টিকোর তলায় থামল।
মিঃ পাণ্ডে এবং এক প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা নেমে এলেন জিপ থেকে। কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে সম্ভাষণ করলেন, আসুন মিসেস সাঁতরা।
ইনিই তা হলে দয়াময়ী সাঁতরা। উজ্জ্বল গৌরবর্ণা ব্যক্তিত্ববতী মহিলা। মুখে মানসিক শক্তির ছাপ স্পষ্ট। পরনে সাদা থান। কাঁধে একটা কিটব্যাগ ঝুলছে। সেটা টেবিলে রেখে শান্তভাবে বসলেন। মিঃ পাণ্ডে বললেন, সোজা স্টেশন থেকে এখানে আসছি। উনি বললেন, আগে আপনার সাথে দেখা করতে চান।