বারান্দার বেতের চেয়ারে আমরা বসলাম। কর্নেল বললেন, বসুন অনিলবাবু।
অনিলবাবু আড়ষ্টভাবে বসলেন। ধরা গলায় বললেন, বাচ্ছ–অচিন্ত্য আমার বাল্যবন্ধু ছিল। জেঠিমার সঙ্গে মন কষাকষি থাকলেও আমাদের বন্ধুত্ব বজায় ছিল। আমি বুঝতে পারছি না, কবে সে কলকাতা থেকে একা এল, কি করেই বা খুন হয়ে গেল? কে তাকে মারল? কেনই বা মারল? অবশ্য বাচ্চু একটু আধটু মস্তানি করে বেড়াত, তা ঠিক। কিন্তু–
অনিলবাবু ফোঁস ফোঁস করে নাক ঝেড়ে কান্না দমন করলেন। রুমালে চোখ মুছলেন। কর্নেল বললেন, আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। আপনি মর্গে আপনার বন্ধুর ডেডবডি দেখতে গেছেন শুনে পোস্টঅফিস থেকে চলে এলাম। আমার শুধু দু-একটা কথা আপনার কাছে জিজ্ঞাস্য ছিল।
বলুন স্যার।
আপনার সন্তানাদি আছে?
আছে স্যার। এক ছেলে, দুই মেয়ে। আনিলবাবু অবাক হলেন। কেন এ কথা জিজ্ঞস করছেন?
তাদের মধ্যে কার বয়স কত?
অনিলবাবু হকচকিয়ে গেলেন, তা স্পষ্ট। বললেন, মেয়ে দুটির বয়স ৭ বছর ৫ বছর। ছেলের বয়স দেড় বছর। কিন্তু–
আপনার স্ত্রীর পড়াশোনা কতদূর?
মাধ্যমিক। কিন্তু এসব কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন স্যার?
আপনার স্ত্রী কি প্রাইভেটে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন?
অনিলবাবুর মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। ছেলেমেয়ে ঘরকন্না সামলাবে, না লেখাপড়া করবে? ছাপোষা গেরস্থ ফ্যামিলি। বাবা বড়লোক আছেন, আছেন। আমি স্যার বাবার হেল্প নেব না বলেই পৃথগন্ন হয়েছি।
বাহ। আপনি পৃথগন্ন বললেন। শুদ্ধ বাংলা। আপনার বাবা পৃথগান বলছিলেন। বুঝতে পারছি আপনি বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা করেন। পৃথক এবং অন্ন সন্ধি করলে পৃথগন্ন হয়। আজকাল যা অবস্থা হয়েছে, শিক্ষিত বাঙালি শুদ্ধ বাংলা বলতে পারেন না। কিছু মনে করবেন না। আপনি কতদূর পড়াশোনা করছেন?
অনিলবাবু গলার ভেতর বললেন, আমি গ্রাজুয়েট।
আর্টস না কমার্স?
কমার্স।
কর্নেল মুখে প্রশংসা ফুটিয়ে বললেন, বাহ্। কমার্সের ছাত্র হয়েও আপনি। শুদ্ধ বাংলা বলতে পারেন। তার মানে, আপনি বাংলা ভাষার রীতিমতো চর্চা করেন। কাল আমার অবাক লেগেছিল, সরকার ডাকঘরে অভিধান সাপ্লাই করেন না। অথচ আপনার টেবিলে বৃহৎ বঙ্গীয় অভিধান। একেবারে নতুন সংস্করণের অভিধান। আজকাল বইয়ের যা দাম। নিশ্চয় অভিধানটা কিনতে একশো টাকার বেশি খরচ হয়েছে। বাংলার বাইরে বাংলা ভাষার চর্চা যারা করেন, তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা হয়।
অনিলবাবু নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিলেন। আমার মনে হচ্ছিল, উনি কর্নেলের কথার লক্ষ্য খুঁজছেন। ঢোক গিলে গম্ভীর মুখে বললেন, আমাদের একটা লাইব্রেরি আছে, বান্ধব পাঠাগার। তার একজিকিউটিভ কমিটির মেম্বার আমি। লাস্ট মিটিং-এ ঠিক হয়েছে, প্রত্যেককে অন্তত দুশো টাকা দামের বই কিনে দিতে হবে। লিফট করে দেওয়াও হয়েছে কাকে কি কি বই কিনে দিতে হবে। আমার একটা অভিধান কিনে দেওয়ার কথা। তাই ওটা কলকাতা থেকে ভি পি করেই আনিয়েছি। দিতে যাওয়ার সময় পাইনি।
কর্নেল হাসলেন। তাই বুঝি? বাহ। চমৎকার সিদ্ধান্ত। আপনাদের লাইব্রেরিটা দেখতে যাব। কিছু ডোনেশনও দেব বই কেনার জন্য।
য়ু আর ওয়েলকাম স্যার। বলে অনিলবাবু উঠে দাঁড়ালেন। নমস্কার করে তেমনই গম্ভীর মুখে নেমে গেলেন বারান্দা থেকে। তারপর সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে লন পেরিয়ে গেট খুলে বেরুলেন। উত্রাইয়ের পথে জোরে সাইকেলে চেপে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এই ভঙ্গিতে খাপ্পা মানুষের লক্ষণ প্রকট ছিল।
বললাম, ভদ্রলোল্পে সঙ্গে রসিকতা করার অর্থ কি?
আভিধানিক অর্থ নিষ্কাশন। কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। তুমি কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিতে পারো। মাত্র ৪৫ মিনিট। কারণ সওয়া তিনটে বাজে।
মিনিট পনের বিছানায় লম্বা হয়েছিলাম, আরামপ্রিয় বাঙালির চিরাচরিত ভাতঘুমের অভ্যাস। হঠাৎ বাইরে জিপের শব্দে ঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল। কর্নেল বারান্দায় ছিলেন। সম্ভাষণ করলেন, আসুন মিঃ পাণ্ডে।
সেই পুলিশ অফিসার পাণ্ডে। কান পাতলাম। পাণ্ডের পুলিশি জুতোর বিচ্ছিরি শব্দ কানে এল। বেতের চেয়ারটা মচমচ করে উঠল। যেন ধপাস করে বসলেন। চাপা স্বরে বললেন, বডির প্যান্টের হিপ পকেটে একটা ছোট্ট মানিব্যাগ পাওয়া গেছে। কিছু টাকাকড়ি আর দুটো ভাঁজকরা ইনল্যান্ড লেটার আছে। একটা সুন্দর সিং পাটোয়ারিজির পক্ষ থেকে ম্যানেজার রাকেশ শর্মার লেখা ইংরেজিতে টাইপ করা চিঠি। অন্যটা বটকৃষ্ণ গুইয়ের লেখা। এই দেখুন।
একটু পরে কর্নেল বললেন, হু। দুটো চিঠিতেই অচিন্ত্যকে ডেকে পাঠানো হয়েছে দেখছি।
বটকৃষ্ণবাবুর চিঠিটা ১ জুলাই লেখা। রাকেশ শর্মারটা ৮ জুলাই।
আজ ১৮ জুলাই।
কলকাতার এন্টালি পোস্ট অফিসের ডেটস্ট্যাম্প দেখুন। বটকৃষ্ণের চিঠি পৌঁছেছে ১৪ জুলাই। কিন্তু রাকেশ শর্মারটা পৌঁছেছে ১৩ জুলাই। লোকাল পোস্ট অফিসের ডেটস্ট্যাম্প পড়া যাচ্ছে না। অস্পষ্ট। আসলে টিকিটের ওপর ছাপ পড়লে তারিখ পড়া যায় না।
মিঃ পাণ্ডে। দুটো ইনল্যান্ডেই প্রেরকের নাম-ঠিকানা নেই দেখছি। যাই হোক, রাকেশ শর্মাকে জিজ্ঞেস করেছেন আশা করি?
অবশ্যই। অচিন্ত্যকে নাকি পাটোয়ারিজি তার কলকাতা অফিসে চাকরি দিতে চেয়েছিলেন। চিঠিটা আ সর্ট অব ইন্টারভিউ। তবে ইন্টারেস্টিং ঘটনা হল, আমাদের একজন ইনফরমার বলেছে, ১৪ জুলাই বিকেলে রাকেশের বাড়িতে বাচ্চু–মানে অচিন্ত্যকে দেখেছিল। রাকেশ অস্বীকার করছে। অথচ সেদিনই সন্ধ্যার একটু আগে কেল্লাবাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণে নদীর ধারে ঢিবির ওপর রাকেশ এবং বাচ্চু বসে ছিল। মর্গের ডোম কানহাইয়ার বউ দেখেছে। সে জৈব প্রয়োজনে নদীর ধারে গিয়েছিল। এই দুটো মার্ডার কেসের তদন্তকারী অফিসার–আই ও মিঃ রামলাল সিংহ ঢিবিতে একটা গাছের তলায় পাথরের স্ল্যাবের নিচে অনেকগুলো সিগারেটের ফিল্টারটিপস আবিষ্কার করেছেন। রাকেশ চেইন স্মোকার। কাজেই তাকে আমরা গ্রেফতার করেছি। তবে এখনই প্রচণ্ড প্রেসাদ আসছে। সুন্দরজি প্রভাবশালী লোক।