সাঁতরাবাবুদেরও গুণ্ডাদল আছে নাকি?
আছে বৈকি স্যার। গুণ্ডা না পুষলে আজকাল ব্যবসা চলে?
তা হলে স্থানীয় লোকের মতে খুনখারাপিটা দলাদলির ব্যাপার?
জি স্যার। সারাবাবুদের অত্যাচারেই জমিদারবাবু কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। জমিদারবাবু পাটোয়ারিজির দোস্ত ছিলেন।
লোকেরা বলছে?
জি স্যার।
পোস্ট অফিসের সামনে রহমত জিপ থামাল। কর্নেল ধীরেসুস্থে নামলেন। বললেন, জয়ন্ত। তুমি বসে থাকো। আমি এখনই আসছি।
কৌতূহল চেপে বসে থাকতে বাধ্য হলাম। কর্নেল পোস্ট অফিসে ঢুকলেন এবং তারপরই বেরিয়ে এলেন। জিপে চেপে বললেন, অচিন্ত্যর লাশের খবর পেয়েই অনিলবাবু ছুটে গেছে। এখনও ফেরেননি। দুজনের মধ্যে একসময় খুব বন্ধুত্ব ছিল। কাজেই এটা স্বাভাবিক। রহমত। আমরা বাংলায় ফিরব।
রহমত আমাদের ফরেস্ট বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। কর্নেল তাকে। চারটে নাগাদ জিপ নিয়ে আসতে বলেছেন।
স্নানাহারের পর কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে মিটিমিটি হেসে বললেন, তুমি। এমন ভাবাচ্যাকা খেয়ে গেছ যে কোন প্রশ্ন তোমার মাথায় আসছে না। যাকে বলে হাল ছেড়ে দেওয়া।
ঠিক বলেছে বস্। বড্ড গোলমেলে ব্যাপার।
খেই পাওয়া গেলে সব জটই ছাড়ানো যায়। কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন। খেইটা ধরিয়ে দিয়েছেন সাঁতরামশাই।
বলেন কি!
হ্যাঁ। গঙ্গা এবং যমুনা। মধ্যিখানে সুড়ঙ্গ।
ওটাই কি সেই খেই?
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, উডল্যান্ড সায়েবের লেখা দা লেটার গুপ্টা আর্কিটেকচার বইটা আমাকে গণ্ডগোলে ফেলে দিয়েছিল। গুপ্তযুগের শেষভাগে মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীতে তিনটে প্রতীক ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বস্তিকা, মকর এবং কচ্ছপ। মকর হল গঙ্গার বাহন এবং কচ্ছপ যমুনার বাহন কাজেই মকর গঙ্গার এবং কচ্ছপ যমুনার প্রতীক।
চমকে উঠলাম। কর্নেল। ওই শব্দছকে–
আমাকে থামিয়ে বৃদ্ধ রহস্যভেদী বলনেল, স্বস্তিকা আছে। তার তলায় মকর, কচ্ছপ এবং রপট আছে। রপট মানে প্রবাহ। কাজেই আমি ধাঁধায় পড়েছিলাম। গুপ্তযুগের কোনও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের কথা ভেবেছিলাম এবং প্রবাহ বলতে ওই নদীটাকে বুঝেছিলাম। নদীর তীরে একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের স্তূপও আছে। কিন্তু ওটা রাজা ভীম রায়ের তৈরি মন্দির। জেলা গেজেটিয়ারে মন্দিরটার যে বর্ণনা আছে, তা মিশ্র স্থাপত্যের। গুপ্তযুগের মন্দিরের মতো স্তম্ভ ছিল না। যাই হোক, সাঁতরামশাই গঙ্গা-যমুনা নামে দুটো পুকুর এবং মধ্যিখানে সুড়ঙ্গের কথা বলা মাত্র শব্দছকের জট খুলে গেল। রপট অর্থাৎ প্রবাহ বলতে এই সংযোগ সুড়ঙ্গই বোঝাচ্ছে। কারণ গ্রীষ্মে যমুনা পুকুরের জল কমে গেলে উঁচু জমিতে গঙ্গা পুকুরের জল সুড়ঙ্গ বেয়ে এসে যমুনাকে ভরিয়ে দেয়।
বললাম, সুড়ঙ্গ তো দেখলাম। কিন্তু ওটা খুঁড়ল কে? কেনই বা খুঁড়ল?
বুঝতে চেষ্টা করো জয়ন্ত। কেদারনাথ থেকে সংসারত্যাগী প্রশান্তবাবু একটা শব্দছক ভাইকে পাঠিয়েছিলেন। রায় বংশের পবিত্র দেবসম্পদ কোথায় আছে, তার সূত্র ওই শব্দছক।
দেব সম্পদ কি?
নাগমিথুন। যার প্রতীক স্বস্তিকা চিহ্ন। বোঝা যাচ্ছে, দামী রত্ন দিয়ে তৈরি ওই নাগমিথুন রপটে–তার মানে প্রবাহপথে লুকোনো ছিল। সুড়ঙ্গের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় ওটা ছিল। নাগমিথুন অর্থাৎ স্বস্তিকা সুড়ঙ্গপথে জলপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি করত না। আবার জলের স্পর্শে তার কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটারও সম্ভাবনা ছিল না। সুড়ঙ্গের গভীরতা পৌনে এক মিটার মতো। সেই ভাঙা মসৃণ পাথরের তলায় চাপ দিয়ে স্বস্তিকা বসানো ছিল। চোর তার সন্ধান পেয়ে খুঁড়ে বের করেছিল। আমার অনুমান, এই প্রকাণ্ড স্বস্তিকা যদি সোনার হয়, তবে তার ওজন কমপক্ষে দু কিলোগ্রাম তো বটেই। কর্নেল চুপ করে গেলেন। কিছুক্ষণ চোখ বুজে দাড়িতে হাত বোলানোর পর ফের বললেন, স্বস্তিকায় গঙ্গা পুকুরের ঘাস ভেসে এসে আটকে যাওয়া সম্ভব কিন্তু তাতে রপটের গতি তত কিছু ব্যাহত হওয়ার কথা নয়। কারণ দুটো পুকুরের জলের যে স্তর দেখেছি, তাতে বুঝেছি গঙ্গাপুকুরের জলের স্তর যমনাপুকুরের জলের স্তর থেকে প্রায় তিন মিটার উঁচু। রপট তীব্রই হত।
অচিন্ত্যবাবু বলেই থেমে গেলেন।
কর্নেল চোখ খুলে আমার দিকে তাকালেন। দয়াময়ী দেবী আমাকে বলেছেন, ওই খামটার কথা তাকে জানাননি। এদিকে দেখা যাচ্ছে, বটকৃষ্ণবাবু খামের ভেতরকার শব্দছকের কথা জানতেন। কিন্তু তিনি ধাঁধার অর্থভেদ করতে পারলে পাটোয়ারিজিকেই স্বস্তিকা বেচে দিয়ে চলে যেতেন ভীমগড় থেকে। আমি নিশ্চিত, তেনি গুপ্তধন আঁচ করছিলেন। কিন্তু সেই গুপ্তধন কি এবং কোথায় লুকানো আছে বুঝতে পারেননি।
কর্নেল, অচিন্ত্যবাবু জমিদার রায়বাবুদের কর্মচারীর ছেলে। তাঁর পক্ষে কেল্লাবাড়িতে লুকিয়ে রাখা স্বস্তিকার কথা জানা কি সম্ভব ছিল না?
ছিল। কিন্তু কোথায় ছিল, তা জানতে পারলে কবে তা হাতিয়ে নিত।
তাহলে খুব সম্প্রতি কেউ স্বস্তিকার সন্ধান পেয়ে ওটা হাতিয়েছে।
ঠিক বলেছ। কর্নেল হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন। সাইকেলে চেপে অনিলবাবু আসছেন। হ্যাঁ, আমি জানতাম উনি আসবেন। আসতেই হবে। এই আবির্ভাব অনিবার্য ছিল।
খোলা জানালা দিয়ে গেটের কাছে পোস্টমাস্টার অনিলবাবুকে সাইকেল থেকে নামতে দেখলাম। কিন্তু বুঝলাম না, কেন ওঁর এই আগমনকে কর্নেল আবির্ভাব বলছেন।
০৮. অভিধান রহস্য
কর্নেলের সঙ্গে বারান্দায় বেরিয়েছিলাম। অনিলবাবুর চেহারা ঝোড়ো কাকের মতো। পোর্টিকোর তলায় সাইকেল রেখে নমস্কার করে বললেন, শচীন বলল আমার খোঁজে গিয়েছিলেন।