ধন্যবাদ। বলে কর্নেল গড়খাইয়ের সেই পাথরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
কেল্লাবাড়ির ভেতরে আমাদের দেখে একজন সপ্রতিভ চেহারার তরুণ পুলিশ অফিসার ব্যস্তভাবে এগিয়ে এলেন। নমস্তে কর্নেলসাব। আমি আর আমেদ।
মিঃ আমেদ, কেল্লাবাড়ির চারদিকে আশা করি নজর রেখেছিলেন আপনারা।
অবশ্যই। গতরাত্রে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল, তবু কনস্টেবলরা সতর্ক ছিল। কিছুক্ষণ অন্তর টর্চের আলো ফেলে জানিয়ে দিচ্ছিলাম, আমরা আছি।
মিঃ আমেদ হেসে উঠলেন। ভেঙে পড়া বাড়ির কাছাকাছি বিশাল বটগাছের তলায় দুটো তেরপলের তাঁবু দেখা যাচ্ছিল। তাবুর সামনে খাঁটিয়ায় বসে ছিল। বন্দুকধারী কয়েকজন কনস্টেবল। কয়লার উনুনে রান্নার আয়োজনও চোখে পড়ল।
কর্নেল ক্যাম্পের দিকে গেলেন না। ডানদিকের গঙ্গা নামে পুকুরটার পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঘন জলজঘাসে ঢাকা পুকুরটার বাকি তিনদিক ঝোপঝাড়ে ঢাকা। আমেদ বললেন, এনিথিং রং স্যার?
নাহ। বলে কর্নেল উল্টো দিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করলেন। বাঁদিকের পুকুরটার পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। এই পুকুরটার নামে শুনেছি যমুনা। এটা একটু নিচুতে। বর্ষায় যমুনাও ভরা এবং ঘন ঘাসে ঢাকা। একটা পানকৌড়ি হঠাৎ উড়ে আমাদের মাথার উপর দিয়ে গঙ্গায় অবতরণ করল। যমুনায় একজোড়া জলপিপি পাখি পি পি করে ডাকতে ডাকতে ঘাসের আড়ালে গা ঢাকা দিল। কর্নেল ঘুরে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমেদ আবার জিজ্ঞেস করলেন, এনিথিং রং স্যার?
কর্নেল হসেলেন, নাহ। পুকুরদুটোর নাম জানেন কি মিঃ আমেদ?
জানি স্যার। ওটার নাম গঙ্গা, এটার নাম যমুনা। শুনেছি, দুটো পুকুরের মধ্যে নাকি একটা গোপন সুড়ঙ্গ আছে। সত্যমিথ্যা জানি না। আমি এখানে প্রায় একবছর এসেছি। অনেক গল্প শুনি। সবই আজগুবি গল্প।
কর্নেল বাইনাকুলারে কিছু দেখতে থাকলেন। তারপর বললেন, ওদিকে একটা মাউন্ড দেখছি। ওটা কি কোন ধ্বংসাবশেষ?
আমেদ বললেন, স্থানীয় লোকেরা বলে, ওখানে নাকি ভীমের মন্দির ছিল। আমার শোনা কথা স্যার।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, মহাভারতের ভীমের মন্দির নয়, রাজা ভীম রায়ের মন্দির। বাদশা আকবরের আমলের এক সামন্ত রাজা। তার নামেই ভীমগড় নাম। তো ওই ঢিবির পেছনেই কি নদী?
হ্যাঁ স্যার। ছোট্ট পাহাড়ি নদী। তবে প্রচণ্ড স্রোত এখন।
কর্নেল ঘুরে আবার গঙ্গার দিকে তাকালেন। তারপর হঠাৎ গঙ্গার দিকে হাঁটতে থাকলেন। এবার বললাম, ব্যাপারটা কি? গঙ্গা-যমুনা খেলতে শত করলেন কেন?
কর্নেল মাঝামাঝি সেই পাথরের ইট বিছানো প্রাচীন পথের ধারে একটা পামগাছের কাছে থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, এখানে সম্প্রতি কেউ মাটি খুঁড়েছিল দেখছি। মাটিটা উঁচু। টাটকা ঘাস গজিয়ে আছে। নাহ, খুব বেশি দিন আগে খোঁড়া নয়। মিঃ আমেদ। আপনাদের ক্যাম্পে খোঁড়ার মতো কোনও শাবল বা কিছু আছে?
আমেদ অবাক হয়ে বললেন, স্যার।
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, এখানেও আর একটা লাশ পোঁতা আছে নাকি? কর্নেল কোনও উত্তর না দিয়ে পিঠের কিটব্যাগ থেকে সেই খুদে খননযন্ত্রটা বের করলেন। তারপর উঁচু ঘাসগজানো ছোট্ট ভূপটা খুঁড়তে থাকলেন। আলগা মাটির চাবড়া বৃষ্টিতে নরম হয়ে আছে। সহজেই খোঁড়া যাচ্ছিল। একটু পরে বেরিয়ে পড়ল ভাঙা পাথরের মসৃণ একটা টুকরো। দেড়ফুট লম্বা প্রায়। অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাথরের টুকরোটা কর্নেল উপড়ে ফেললেন। ফাটলের ভেতর জল দেখা গেল। আমেদ উত্তেজিতভাবে বললেন, আশ্চর্য। তাহলে দেখা যাচ্ছে সত্যি একটা সুড়ঙ্গ আছে?
মিঃ আমেদ। প্লিজ, ওই ঝোপ থেকে একটা লম্বা ডাল ভেঙে আনুন।
আমেদ দ্রুত ডাল ভেঙে আনলেন। কর্নেল ডালটা সুড়ঙ্গে ভরে গভীরতা মেপে বললেন, প্রায় পৌনে এক মিটার গভীর। চওড়া আধ মিটার। কিন্তু এই গর্ত খুঁড়েছিল কে, এটাই প্রশ্ন।
আমেদ হাসলেন। কেউ দেখতে চেয়েছিল সুড়ঙ্গের গুজব সত্যি কি না।
কর্নেল সুড়ঙ্গের জলে তার খুন্তি ধুয়ে কিটব্যাগে ঢোকালেন। তারপর বললেন, চলি মিঃ আমেদ। আমি মিঃ পাণ্ডেকে বলব, আজই যেন ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়া হয়। কারণ আর এখানে নজর রাখার দরকার নেই।
বলে উনি হন্তদন্ত গড়খাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন।
গড়খাইয়ের ওধারে পুলিশকে ভিড়ের উদ্দেশে ধমক দিতে এবং লাঠি তুলতে দেখছিলাম। অ্যামবুলেন্স চলে গেছে। মিঃ পাণ্ডেকেও দেখলাম না।
জিপে উঠে কর্নেল রহমতকে বললেন, পোস্ট অফিস।
রহমত জিপ চালিয়ে যেতে যেতে বলল, কিছু বুঝতে পারছি না কর্নিল সাব। কেল্লাবাড়ির জমি নিয়ে নাকি মামলা চলছে অনেক বছর ধরে। কিন্তু খুনখারাপি কখনও হয়নি। লোকেরা বলাবলি করছিল, খুনের বদলেই খুন হয়েছে। এবার আরও খুনোখুনি হবে। সে কণ্ঠস্বর চাপা করল। পাটোয়ারিজি কেল্লাবাড়ি কিনতে চান এই মওকায়। তাই উনি নাক গলিয়েছেন স্যার। পাটোয়ারিজির ভাতিজার হাতে ভীমগড়ের সব গুণ্ডা বাঁধা। শুনলাম, বটবাবুকে খুনের জন্য পাটোরারিজি খাপ্পা হয়ে সাঁতরাবাবুদের আসামী করতে চাইছেন! বটবাবু পাটোয়ারিজির লোক ছিল কি না।
কর্নেল বললেন, আজ যে লাশটা পাওয়া গেল, সে সম্পর্কে স্থানায় লোকেরা কি বলছে?
অনেকে অনেক কথা বলছে স্যার। এই লোকটাও নাকি একসময় পাটোয়ারিজির ভাতিজার দলের গুণ্ডা ছিল। বাচ্চুবাবু না কি যেন নাম। তো সে দল থেকে ভেগে সাঁতরাবাবুদের দলে ভিড়েছিল।