কর্নেল প্রায় অট্টহাসি হাসলেন। সেবাযত্ন? নাহ সাঁতরামশাই। এই যে আপনি সরল মনে কথা বলছেন, এটাই আমার কাছে যথেষ্ট সেবাযত্ন।
এবার সাঁতরামশাইয়ের মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, বটোর কোনও ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না স্যার। মা কালীর দিব্যি। বিশ্বাস করুন।, না, না। আমি ও ব্যাপারে আসিনি। আপনি নিশ্চিন্ত হোন। বলে কর্নেল একটু বললেন, আপনার ছোটছেলে অনিলবাবু দুঃখ করে বলছিলেন, বাবা আমাকে মিথ্যেমিথ্যি ভুল বোঝেন।
সাঁতরামশাই নিমেষে আবার খাপ্পা হলেন। মিথ্যেমিথ্যি? ও এবাড়ি ইদানীং যাতায়াত করছে বা কথাবার্তা বলছে বটে, কিন্তু অন্য কোনও বাবা হলে ওকে লাঠিপেটা করত। ত্যজ্যপুত্র করে ছাড়ত। ঘরের শত্রু বিভীষণ।
আমার মনে পড়ল, গতকাল সন্ধ্যায় সুনীলবাবুও এই কথাটা বলেছিলেন ছোটভাই সম্পর্কে। তাই আমিই প্রশ্নটা করে ফেললাম, অনিলবাবু কেন ঘরের শত্রু বিভীষণ সাঁতরামশাই?
কর্নেল দ্রুত বললেন, ওসব পারিবারিক ব্যাপার ওঁদের। সব পরিবারেই এটা থাকে।
সাঁতরামশাই খাপ্পা হয়েই ছিলেন। বললেন, না স্যার। কোনও পরিবারে এমন শত্রু থাকে না। ওর মা বেঁচে থাকলে অ্যাদ্দিন–হুঁ। নেহাত আমি ভালমানুষ বলেই চুপচাপ আছি।
কর্নেল অমায়িক কণ্ঠস্বরে বললেন, ব্যাপারটা খুলে বললে আমি অনিলবাবুকে শায়েস্তা করে দিতে পারি সাঁতরামশাই।
সাঁতরামশাই চাপা স্বরে বললেন, বউদির সন্তানাদি নেই। পুষ্যি নিয়েছেন। নরেনবাবুর ছেলে অচিন্ত্যকে। মহা ধড়িবাজ গুণ্ডা। বউদির শখের বেড়াল। কিন্তু বেড়ালের চেয়ে ধূর্ত স্যার। সেই হারামজাদার সঙ্গে অনিলের একসময় গলাগলি ভাব ছিল। বুঝলেন?
বুঝলাম। বলুন।
সেই বদমাসটি ওই গাধা–মানে অনিলকে দিয়ে আমার সিন্দুক থেকে একটা দলিল রেকর্ড-পরচানকশার ফাইল হাতিয়ে বউদিকে দিয়েছিল। ফাস্ট সেটলমেন্টের রেকর্ড-নকশা স্যার। সব বাবা আমার জিম্মায় রেখেছিলেন। কারণ আমার দাদা ছিল মনভোলা ধরনের লোক। খামখেয়ালি যাকে বলে।
তারপর?
তারপর আর কি? যেমনই সন্দেহ হল, অনিলকে পৃথগান্ন করে দিলাম। নাও। এবার ঠেলা বোঝ। হারামজাদা এমনই গোঁয়ার, এখনও বলে, বেশ করেছি। কিন্তু কি করব বলুন? নিজের ছেলে। ঘরের শত্রু বিভীষণ হলেও ওর মায়ের মুখ চেয়ে ক্ষমাঘেন্না করে স্যার। ওকে শায়েস্তা করে দিন তো। আপনার সেবাযত্নের ত্রুটি হবে না।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। আসি সাঁতরামশাই।
সাঁতরামশাই গেট পর্যন্ত বিদায় দিতে এলেন। আবার চাপাস্বরে সেবাযত্নের কথা তুললেন। বুঝলাম, কথাটার মানে ঘুষ। গেটে দাঁড়িয়ে কর্নেল হঠাৎ বললেন, আর একটা কথা সাঁতরামশাই। বটকৃষ্ণবাবু কি কখনও আপনাকে বলেছিলেন কেল্লাবাড়ির গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছেন?
আচমকা এই প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সাঁতরামশাই বললেন, ধড়িবাজ ঠগ। ওইরকম কত মিথ্যা কথা বলত। ওর কথা আমি কানে নিতাম না।
তাহলে উনি বলেছিলেন আপনাকে?
সাঁতরামশাই বললেন, হ্যাঁ। মিথুকের শিরোমণি।
এইসময় এক ভদ্রলোক সাইকেল চালিয়ে আসছিলেন। সাইকেল থামিস উত্তেজিতভাবে বললেন, নবদা। সর্বনেশে কাণ্ড। কেল্লাবাড়িতে পুলিশ আবাদ একটা ডেডবডি পেয়েছে। মাটির তলায় পোঁতা ছিল। কার বডি জানো, তোমার বউদির পুয্যি সেই অচিত্যের বডি। বাপ। আমার মাথা বন বন কয়ে ঘুরছে।
০৭. অনিলবাবুর আবির্ভাব
কেল্লাবাড়ির গড়খাইয়ের সামনে পৌঁছনো পর্যন্ত আমি বিস্ময়ে হতবাক ছিলাম। কর্নেল নির্বিকার মুখে বসে ছিলেন। সবে অ্যাম্বুলেন্সে লাশ ঢোকানো হয়েছিল। কর্নেলকে দেখে একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে এলেন। বললেন, স্থানীয় লোকেরা লাশটা সনাক্ত করেছে, কর্নেল সরকার। এখানে একসময় থাকত সে। অচিন্ত্য দাস নাম। ডাকনাম ছিল বাচ্চু। গুণ্ডা প্রকৃতির যুবক। পরে সাঁতরা ফ্যামিলির এক মহিলা তাকে পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে সে কলকাতা চলে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে তার সঙ্গেই এখানে আসত।
জানি। কর্নেল আস্তে বললেন। বডি কি অবস্থায় ছিল তার মানে, পচন ধরেছিল কি না?
হ্যাঁ, জায়গায় জায়গায় চামড়া খসে গেছে। কালো হয়ে গেছে। আমার ধারণা, অন্তত ৭২ ঘণ্টা আগে খুন হয়েছে। একই পদ্ধতিতে খুন। মাথার পেছনে শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করেছিল খুনি। খুলি ফাঁক হয়ে গেছে।
মিসেস দয়াময়ী সাঁতরাকে খবর দেওয়া দরকার। উনি কলকাতায় আছেন।
সাঁতরাবাড়িতে আমাদের অফিসার গেছেন। এখান থেকে হাঁটাপথে শর্টকাট করা যায়।
কর্নেল পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে বললেন, আপনি বরং থানায় গিয়ে এই নম্বরে কলকাতায় ট্রাঙ্কল করুন মিঃ পাণ্ডে। মিসেস সাঁতরাকে আমাদের খুবই দরকার। ট্রাঙ্ককলে খবর পেলেই ছুটে আসবেন।
আপনি কি বড়ি দেখতে চান?
নাহ্। তবে মর্গে বডির পোশাক সার্চ করা জরুরি। পরনে কি পোশাক আছে।
প্যান্ট আর গেঞ্জি। পায়ে চপ্পল আছে। আশ্চর্য কর্নেল সরকার, খুনটা ওখানেই করা হয়েছে বলে মনে হল। মানে, যেখানে বডি পোঁতা ছিল, সেখানেই। বুঝতে পারছি না, ওই বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকা ভাঙা ছাদের তলায় সে কি করছিল?
কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, আমি কেল্লাবাড়িতে যাচ্ছি মিঃ পাণ্ডে। তো ভেতরে পুলিশ ক্যাম্প বসাতে বলেছিলাম—
ক্যাম্প করা হয়েছে। এ এস আই আমেদকে আপনার কথা বলা আছে। আমেদ ক্যাম্পের চার্জে আছে।