বলে কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে টুপি পরলেন। বাংলোর পোর্টিকোর তলায় জিপের দিকে এগিয়ে গেলেন। রহমত ছুটে এল। বৃষ্টি এখন কমে গেছে। টিপ টিপ করে পড়ছে। সমতলে বড় রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, রহমত। আমরা নবকুমার সাঁতরার বাড়ি যাব।
জিজ্ঞেস করলাম; কেল্লাবাড়ি যাবেন না?
আগে ওঁর বাড়ি। তারপর কেল্লাবাড়ি।
গতরাতে এলাকাটা রহস্যময় মনে হয়েছিল। দিনের আলোয় দেখলাম মোটামুটি ভদ্র পরিবেশ। একটা করে পুরনো বাগানবাড়ি। তার পাশে একালীন ঝকমকে স্থাপত্য। প্রচুর গাছপালা, এমন কি আম বাগানও আছে। একটা সুন্দর মন্দির দেখতে পেলাম। কালীমন্দির না হয়ে যায় না। চোখে পড়ল পুরনো কিন্তু মেরামতে ভোলফোরানো একতলা একটা লাইব্রেরি এবং সাইনবোর্ডে বাংলায় লেখা বান্ধব পাঠাগার। স্থাপিত ১৯৩১ খৃঃ। শুধু রাস্তাটাই যা বিচ্ছিরি।
সাঁতরাবাবুর নতুন বাড়ির পেছনে পুরনো বাড়িটা বেমানান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গেটে জিপ থামলে আবার কুকুরের হাঁকডাক শোনা গেল। রহমত নেমে গিয়ে ডাকছিল, বাবুজি। বাবুজি।
কর্নেল নামার পর আমি নামলাম। দোতলার বারান্দায় গ্রিলের ভেতর আবছা দেখা যাচ্ছিল এক প্রৌঢ়কে। প্রকাণ্ড উঁড়ি। গায়ে ফতুয়া এবং পরনে লুঙি। বললেন, কে-এ-এ?
রহমত বলল, সাবলোগ কালকাত্তাসে আয়া বাবুজি। আপকা মুলাকাত মাঙতা।
একটু পরে তিনি গেটের কাছে এলেন। কর্নেল নমস্কার করে বললেন, আমি কাল সন্ধ্যায় এসেছিলাম। নবকুমার সাঁতরা মশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
আমিই নবকুমার সাঁতরা। ভেতরে আসুন।
অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম বটে, কিন্তু একটা অস্বস্তি ঘুচে গিয়েছিল। এই ভদ্রলোকের লাশ কেল্লাবাড়িতে মাটির তলায় থাকা বরদাস্ত করতে পারছিলাম না। কেন পারছিলাম না কে জানে।
বসার ঘরে সোফা এবং আলমারিতে পুতুল আছে। একটা ডিভান আছে। কিন্তু শিক্ষা-সংস্কৃতির ছাপ নেই। বিত্তবান ব্যবসায়ীদের মতো ঐশ্বর্য প্রদর্শনেরও প্রবণতা চোখে পড়ল না। সোফায় বসে কর্নেল নিজের নেমকার্ড দিলেন। নবকুমার তা পড়ে দেখে কর্নেলকে ফেরত দিলেন। একটু আড়ষ্টভাবে হেসে বললেন, সুনীলের কাছে শুনেছি, বউদি আমার পেছনে সি আই ডি
কর্নেল বাধা দিলেন। না সাঁতরামশাই। আমি পুলিশ নই। এক সময় সামরিক অফিসার ছিলাম। এখন রিটায়ার্ড। আর আলাপ করিয়ে দিই। জয়ন্ত চৌধুরী। কলকাতার প্রখ্যাত দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।
সাঁতরামশাই আমার দিকে মন দিলেন না। বললেন, কাল রাতে কলকাতা থেকে ফিরেছি। ট্রেন দুঘণ্টা লেট। সুনীল আপনাদের কথা বলল। এদিকে সক্কালবেলা বটো খুন হয়েছে শুনলাম। আমি স্যার কোনও ব্যাপারে নেই। বউদি খামোকা আমাকে ভুল বুঝেছে। তারই হেস্তনেস্ত করতে কলকাতা গিয়েছিলাম। বউদি তার প্রপার্টির শেয়ার বেচবে না। বেচবে পাটোয়ারিজিকে। বড্ড জেদী মেয়ে স্যার।
কর্নেল বললেন, রায়বাবুর সঙ্গে আপনাদের মামলার কি অবস্থা?
মামলা হাইকোর্টে ঝুলে আছে। তবে বউদি রাজি হলেই মিটে যাবে। রায়মশাইয়ের আশি বছর বয়স হয়েছে। ছেলে নেই। একটি মাত্র মেয়ে। সে বরের সঙ্গে আমেরিকায় থাকে। রায়মশাই গঙ্গা-যমুনা আমাদের দিয়ে কেল্লাবাড়ির বাকি অংশ–
এক মিনিট। কি বললেন? গঙ্গা-যমুনা?
আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। কেল্লাবাড়িতে দুটো পুকুর আছে। একটার নাম গঙ্গা, অন্যটার নাম যমুনা। পুকুর দুটো আর ওই অংশের জমি রায়মশাইয়ের দাদা আমাদের বিক্রি করেছিলেন। তারপর উনি সাধু হয়ে চলে গেলেন। তখন রায়মশাই মামলা ঠুকে দিলেন এজমালি সম্পত্তি। দাদা ভাইকে না জানিয়ে বেচতে পারে না। এই হল গিয়ে মামলা।
কর্নেলকে উত্তেজিত মনে হল। চুরুট ধরিয়ে বললেন, গঙ্গা-যমুনা।
আজ্ঞে স্যার। শুনেছি, ওঁর ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা নাকি দুটো পুকুর খুঁড়ে একটাতে গঙ্গার জল, অন্যটাতে যমুনার জল এনে ভরেছিলেন। লাখ লাখ জালায় জল ভরে আনা হয়েছিল নাকি প্রয়াগ সঙ্গম থেকে। সত্যিমিথ্যা ভগবান জানেন। শুকনো হাসি হাসলেন সাঁতরামশাই। তবে সেকালে রাজা জমিদারদের খেয়াল ওইরকমই ছিল। সত্যি হতেও পারে। শুনেছি, পুকুর দুটোর মধ্যিখানে মাটির তলায় সুড়ঙ্গ আছে। যমুনার জল খায় কমে গেলে গঙ্গার জল সুড়ঙ্গ দিয়ে যমুনায় ঢোকে। আমি স্যার অত কিছু দেখার সময় পাইনি কখনও। লোকের মুখে যা শুনেছি, তাই বলছি।
আপনারা গঙ্গা-যমুনা কিনেছিলেন কেন?
আসলে দাদার খেয়াল। দাদা মাছ চাষ করার জন্য কিনতে চেয়েছিল। তা দাদার ইচ্ছা আমার ইচ্ছা। বলে সাঁতরামশাই হাঁক দিলেন, বেচু। এঁদের চা-ফা নিয়ে আয়।
কর্নেল বললেন, না সাঁতরামশাই। আমরা চা খাই না। এবার একটা কথা জানতে চাই। বটকৃষ্ণবাবুর সঙ্গে কি আপনি একই ট্রেনে কলকাতা গিয়েছিলেন?
বটোর সঙ্গে? আমি? আমার মাথা খারাপ হয়েছে? বটো ছিল বউদির চর। তার ওপর মিথ্যা করে বউদির নামে আমাকে লাগাতে আসত। আবার আমার নামে বউদির কান ভারী করত। সাঁতরা মশাই খাপ্পা হয়ে উঠেছিলেন। আপনি জানেন না স্যার। ওই বটোই রায়বাবুকে আমাদের নামে একইভাবে মিথ্যেমিথ্যি কি সব বলে আসত। বরাবর ওর এই স্বভাব ছিল। আমার ছোট ছেলে অনিল পোস্টমাস্টার। ওকে জিজ্ঞেস করলেই
কর্নেল বললেন, করেছি।
ও হ্যাঁ। সুনীল বলছিল বটে। আপনারা আগে অনিলের কাছে গিয়েছিলেন। সাঁতরামশাই কাঁচুমাচু মুখে হেসে চাপা স্বরে ফের বললেন, দয়া করে একটু খুলে বলুন না স্যার, কি ব্যাপার? আপনাদের সেবাযত্নের জন্য যতটা করা দরকার, আমি করব।