পুলিশ স্টেশন নিউ টাউনশিপ এলাকায়। পৌঁছুতে সাড়ে নটা বেজে গেল। কর্নেল বললেন, তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি, খিদে পেয়েছে। তুমি বসে থাকো। আমি এখনই আসছি।
উনি নেমে গেলেন। গেটে সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে ছিল। কর্নেল তার পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন।
রহমত দুঃখিত মুখে বলল, আজকাল খুনখারাপি লেগেই আছে। কেউ আইনকানুন মেনে চলছে না। পুলিশ কিছু করবে ভাবছেন? কিছু না। তবে স্যার,
ওই বাবু পাটোয়ারিজির গদিতে কাজ করতেন। দেখা যাক, ওঁরা পুলিশকে চাপ দিয়ে কিছু করাতে পারেন কি না। সুন্দরজি খুব বড়া আদমি। মিনিস্টার, এম এল এর সঙ্গে ওঁর চেনাজানা আছে। কিন্তু ওই বাবুজিরও দোষ আছে স্যার।
কি দোষ?
জেলখাটা লোক। পোস্ট অফিসের পিয়ন ছিলেন। তারপর চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। লোককে ঠকিয়ে পয়সা কামাতেন। তো আমি বুঝতে পারছি না উনি খণ্ডহরে কেন গিয়েছিলেন? আর শাবলই বা ওখানে কে নিয়ে গেল? রহমত মুখে রহস্য ফুটিয়ে বলল, শুনেছি, কেল্লাবাড়িতে খাজানা (গুপ্তধন) পোঁতা আছে। থাকতেই পারে। পুরনো আমলের রাজবাড়ি। কলকাতার বাঙালি জমিদারবাবুরা কোন আমলে খরিদ করেছিলেন। আমি বছর তিনেক আগে এখানে বদলি হয়েছি। কত গল্প শুনি।
সে গল্প শোনাতে থাকল। আজগুবি সব গল্প। তারপর কর্নেল ফিরে এসে বললেন, সোজা ফরেস্ট বাংলো, রহমত। তারপর আমার দিকে ঘুরে আস্তে করে বললেন একটা লাশ পোঁতা আছে বলেছি পুলিশকে। তবে কার লাশ তা বলিনি। কারণ যদি অন্য কারও লাশ হয়?
০৬. অচিন্ত্যনীয় ঘটনা
কৃপানাথ ব্রেকফাস্ট রেডি রেখেছিল। বারান্দায় বসে ব্রেকফাস্টের সময় ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি এল। রহমত কৃপানাথের সঙ্গে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বটকৃষ্ণবাবুর খুনখারাপি নিয়ে আলোচনা করছিল।
বললাম, পুলিশ আপনাকে পাত্তা দিল?
কর্নেল বললেন, তুমি তো বরাবর দেখে আসছ, এসব ক্ষেত্রে কলকাতা। থেকে থু প্রপার চ্যানেলে আমি যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখি। এস পি ভীমগড় থানাকে রেডিও মেসেজে আমার কথা জানিয়ে রেখেছিলেন। তবে আমি কোথায় উঠব, তা বলিনি। যাই হোক এস পি ভদ্রলোক রসিক। থানাকে জানিয়েছিলেন, অসময়ে কলকাতা থেকে এক সান্তা ক্লজ আসছেন। তার সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে। থানার অফিসাররা অবশ্য বুঝতে পারেননি কেন কোন সান্তা ক্লজ বুড়ো এই বর্ষায় এখানে আসছে এবং তাকে কী ভাবে সহযোগিতা করতে হবে। এখন তারা আমাকে চর্মচক্ষে দেখে এবং এই হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার ফলে আমার বোয় তৎপর হয়ে উঠলেন। নাহ্। আমি দয়াময়ী সাঁতরার নাম করিনি, কিংবা স্বস্তিকা আঁকা শব্দছকের কথাও ওঁদের জানাইনি। শুধু বলেছি, এটা সাধারণ খুনখারাপি নয়। এর সঙ্গে একটা জটিল রহস্য জড়িয়ে আছে। আপনারা কেল্লাবাড়িতে পুলিশক্যাম্প বসান। কেল্লাবাড়িতে যেন জনপ্রাণীটি না যায় আর। যদি কাউকে সেখানে দেখা যায়, তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। কি। উদ্দেশ্যে সে গিয়েছিল, জেরা করে জেনে নিতে হবে।
বৃষ্টি জোরালো না হলেও সমানে ঝিরঝিরি ধারায় ঝরছিল। সেই সঙ্গে এলোমলো হাওয়া। বাংলোটা টিলার মাথায় বলে হাওয়ার দৌরাত্ম্য বেশি। ব্রেকফাস্টের পর ঘরে গিয়ে জানালার ধারে বসলাম। ওদিকটায় ঢেউ খেলানো ঘনসবুজ অরণ্যযতদূর চোখ যায়। মাঝে মাঝে বেখাচ্চা একটা করে কালো নগ্ন পাথরের পাহাড় অতিকায় হাতির মতো দাঁড়িয়ে আছে।
কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে চুরুট টানছিলেন। পাশের টেবিল থেকে সেই গাদা বইটা হঠাৎ তুলে নিলেন। তারপর পাতা ওল্টাতে থাকলেন। দেখলাম, একগুচ্ছ মন্দিরের ফটোয় পৌঁছে ওঁর হাত থামল। এবার আতস কাচ দিয়ে ফটোগুলোতে কিছু দেখতে মন দিলেন। কিছুক্ষণ পরে সশব্দে বইটা বুজিয়ে রেখে বললেন, ওঠ। বেরুনো যাক।
অর্কিডের খোঁজে বেরুলে আমি যাচ্ছি না।
নাহ। কেল্লাবাড়িতে পুঁতে রাখা লাশটা সত্যিই নবকুমারবাবুর কি না জানা দরকার। গত রাতে ওঁর বড় ছেলের মুখে শুনেছি, উনি দুদিন আগে কলকাতা গেছে। এদিকে বটকৃষ্ণবাবুর চিঠিতে বলে থেকে গেলেন কর্নেল। স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে ফের বললেন, স্থা, বুঝেছি। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভারি অদ্ভুত তো।
ওঃ কর্নেল। আবার বটকৃষ্ণবাবুর সেই শেষ সংলাপ।
সংলাপটা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে জয়ন্ত। তোমার সংলাপের শেষাংশ স্মরণ করো। তুমি বলেছিলে, ব্যাপারটা টপ সিক্রেট কি না। নামী লোক।
আপনার মুখস্থ আছে দেখছি।
হ্যাঁ, কর্নেল দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, তার উত্তরেই বটকৃষ্ণবাদত ওই তিনটি কথা। তুমি বলেছিলে নামী লোক। তাই তার হত্যাকাণ্ড পলি চেপে রেখে তদন্ত চালাচ্ছে–টপ সিক্রেট। এগুলোর জবাবে বটকৃষ্ণবাবর উক্তি, হুঁ। বুঝেছি। কিন্তু পরের বাক্যে তাঁর উক্তি–তা কি করে সম্ভব? জয়ন্ত। এখন মনে হচ্ছে, সেই নামী লোক, যার খুন হওয়ার সম্ভাবনা আঁচ করেছিলেন বটকৃষ্ণবাবু, কি করে খুন হতে পারেন, এটাই ভারি অদ্ভুত মনে হয়েছিল বটকৃষ্ণবাবুর কাছে। কেন মনে হয়েছিল? না, না। তখন আমি ওই তিনটি কথার মানে খুঁজতে ভুল দিকে ছুটেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে ঠিক দিকেই চলেছি।
ঠিক দিকটা কি?
যার খুন হওয়ার সম্ভাবনা বলে ধারণা ছিল বটকৃষ্ণবাবুর, তিনি নিশ্চয় বটকৃষ্ণবাবুর সঙ্গে একই ট্রেনে কলকাতা গিয়েছিলেন, কিংবা বটকৃষ্ণবাবু তাকে একই ট্রেনে কলকাতা যেতে দেখেছিলেন। জয়ন্ত, বটকৃষ্ণবাবু আসলে নবকুমারবাবুর কথা ভেবেই ওই উক্তি করেছিলেন। সিওর। হানড্রেড পারসেন্ট সিওর।