কর্নেল বললেন, লাশ প্রথমে কে দেখতে পেয়েছিল?
মুসহর বস্তির একটা লোক স্যার। সে একটা খরগোশ তাড়া করে এসেছিল। লাশ দেখে সে বাঙালিটোলায় খবর দেয়। তারপর পুলিশের কাছে খবর যায়।
কি দিয়ে খুন করা হয়েছে জানো?
মাথার পিছনে শাবলের ঘা মেরেছিল খুনি। শাবলটা পাশেই পড়ে ছিল। পুলিশ নিয়ে গেছে।
পাটোয়ারিজি বা তার কোন লোক এসেছিল দেখেছ?
জি হাঁ। ওঁর ভাতিজা, আরও অনেকে এসেছিল।
লাশ কি অবস্থায় পড়েছিল?
উপুড় হয়ে।
হুঁ, খুনি পিছন থেকে মাথায় ঘা মেরেছিল। বলে কর্নেল ধাপ বেয়ে উঠলেন। বারান্দার দুটো মোটা থামের অর্ধেক ভাঙা এবং বারান্দা ধ্বংসস্তূপে ঢাকা পড়েছে।
রহমতের নিষেধ গ্রাহ্য না করে কর্নেল বারান্দার ধ্বংসস্তূপের উপর দিয়ে চলে গেলেন। আমি কৌতূহলী হয়ে ওঁকে অনুসরণ করলাম। রহমত পিছন। থেকে বলল, আমি জিপের কাছে যাচ্ছি স্যার।
কর্নেল একটি দরজার ফাঁকে ঝোপ সরিয়ে উঁকি দিচ্ছিলেন। সেইসময় লক্ষ্য করলাম, ঝোঁপের একপাশটা কাত হয়ে আছে এবং ছোট কয়েকটা ডাল ভেঙে পড়েছে। টাটকা ভাঙা বলে মনে হল। সেদিকে কর্নেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। উনি শুধু বললেন, দেখেছি।
তারপর উনি মেঝের ধ্বংসস্তূপে উঠে থমকে দাঁড়ালেন। ওঁর মুখে বিস্ময় লক্ষ্য করে বললাম, কি?
কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন, পুলিশের এটা চোখে পড়া উচিত ছিল। তবে আমি প্রকৃতিচর বলেই প্রকৃতির কোথাও যেটুকু অস্বাভাবিকতা আবিষ্কার করতে পারি, পুলিশ তা পারে না। বিশেষ করে বর্ষাকাল এবং গত তিনদিন ধরে বৃষ্টি হয়েছে। তার ফলে অস্বাভাবিকতা অনেকটা ঘুচে গেছে।
এবার আমিও সাবধানে পা ফেলে ভূপটায় উঠলাম। একপাশে বিপজ্জনকভাবে দুটো লোহার বর্গার কিছুটা নেমে এসে স্কুপে ঢুকেছে। তার উপর ছাদের খানিকটা অংশ এবং তলায় ঘন ছায়া। মেঝের বাকি অংশে বোদ্র পড়েছে। বললাম, খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ন নাকি?
নাহ। কেউ খুঁড়তেই এসেছিল। খোঁড়া হয়নি। উল্টোদিক থেকে কেউ এসে পড়েছিল। ওই যে দেখছ, উল্টোদিকের দরজার ঝোঁপেরও একই অবস্থা।
বলে কর্নেল কিটব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট খুন্তির মতো জিনিস বের করলেন। বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের চারা সংগ্রহে ওটা ওঁকে ব্যবহার করতে দেখেছি। এবার উনি দুহাতে রবারের দস্তানা পরে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থেকে ছাদটুকুর তলায় ঢুকে গেলেন। সাবধান করতে গিয়ে থেমে গেলাম। জানি, উনি আমার কথায় কান দেবেন না।
প্রায় মিনিট দুই খোঁড়ার পর কর্নেল বেরিয়ে এলেন। একটু হেসে বললাম, গুপ্তযুগের প্রত্নভাস্কর্য খুঁজেতে বড্ড বেশি রিস্ক নিচ্ছেন কিন্তু। এখানে সাপের আচ্ছা।
কর্নেল বললেন, অত্যুৎসাহী বটকৃষ্ণবাবু নিজের বুদ্ধির দোষেই প্রাণটা খুইয়েছেন। বেচারার জন্য দুঃখ হচ্ছে।
উনি বেরিয়ে গেলেন। সোপানে পৌঁছে বললাম, বটকৃষ্ণবাবু কি প্রত্নভাস্কর্যের খোঁজে এসেছিলেন?
নাহ্। একটা লাশের খোঁজে।
চমকে উঠলাম। তার মানে?
একটা লাশের খোঁজে এসে বেচারা নিজেই লাশ হয়ে গেছেন।
কার লাশ?
নবকুমারবাবুর বলেই ধরে নেওয়া যায়। কারণ চিঠিতে বটকৃষ্ণবাবু আমাদের একথা জানিয়েছিলেন। পাছে আমি ওঁর কথা গ্রাহ্য না করি, তাই নিজের জুতো ফেলে দিয়ে এসেছিলেন বাংলায়। তার পরও যখন উনি দেখলেন আমি গ্রাহ্য করছি না, তখন ভোরবেলায় উনি নিজেই ওই পুঁতে রাখা লাশ খুঁড়ে বের করতে এসেছিলেন। সেই সময় আততায়ী ওঁকে অনুসরণ করে এসেছিল। তারপর ওঁর শাবল কেড়ে নিয়ে ওঁকেই লাশ বানিয়ে গেছে।
আপনি এমনভাবে বলছেন যেন নিজের চোখে সব দেখেছেন।
চিহ্নগুলি এক একটি তথ্য। তথ্যগুলি থেকে আমার কাছে এই ঘটনা এসে দাঁড়াচ্ছে।
কার পুঁতে রাখা লাশ খুঁড়ে বের করতে গেলেন কেন বটকৃষ্ণবাবু?
লাশের খবর হলে আমি গিয়ে পড়ব, উনি জানতেন। কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন, আমার ভুলে নয়, নিজের ভুল এবং হঠকারিতায় বটকৃষ্ণবাবু মারা পড়লেন। একটু ধৈর্য ধরা ওঁর উচিত ছিল। বড় অদ্ভুত চরিত্রের লোক ছিলেন বটকৃষ্ণ গুই। কিংবা–
কিংবা?
ওঁর মনে কোনও অভিসন্ধি ছিল। এমনও হতে পারে, আমার হাত দিয়ে হুঁকো খেতে চেয়েছিলেন।
হুঁকো খেতে? সে আবার কি?
কর্নেল বিষণ্ণভাবে হাসলেন। পুরনো বাংলা প্রবচন আছে, পরের হাতে হুঁকো খাওয়া।
তা হলে বলুন, গুপ্তযুগের সেই প্রত্নভাস্কর্য উদ্ধারের সূত্র আপনার সাহায্যে–
কর্নেল থমকে দাঁড়ালে চুপ করলাম। উনি পাথুরে পথটার দুধারে পুকুর দুটি দেখতে থাকলেন।
একটু পরে বললেন, আশ্চর্য তো!
আমাদের বাঁদিকের পুকুরটা উঁচুতে এবং ডানদিকেরটা নিচুতে। বলে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। এখনই থানায় যেতে হবে। দেরি করা ঠিক হচ্ছে না
এই নিরিবিলি জায়গায় তার আগেই যদি নবকুমারবাবুর লাশ খুনি সরিয়ে ফেলে? দিনদুপুরে তা পারবে না। ওদিকে মুসহর বস্তি আছে নদীর ধারে। তাছাড়া কৌতূহলী লোকেরা ঘটনাস্থল দেখতে আসতে পারে। তাদের চোখে পড়বে। বলে কর্নেল আঙুল তুললেন। ওই দেখ, একদল লোক আবার আসছে। খবর ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ।
নানা বয়সী একদল লোক কর্নেলের দিকে কেমনচোখে তাকাতে তাকাতে পাশ কাটিয়ে গেল। পাদ্রিবাবা ভাবল কি না কে জানে!
রহমত জিপের কাছে অপেক্ষা করছিল। গড়খাই পেরিয়ে গিয়ে আমরা জিপে চাপলাম। কর্নেল বললেন, এবার পুলিশ স্টেশন চলো রহমত।