Site icon BnBoi.Com

সবুজ বনের ভয়ংকর – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সবুজ বনের ভয়ংকর - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

০১. কথা বলা বন

মার্চের এক রবিবারের সকালে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ফ্ল্যাটে অভ্যাসমতো আড্ডা দিতে গিয়ে দেখি, বৃদ্ধ ঘুঘুমশাই অফিসের বড়কর্তার মতো একটা ফাইল খুলে গোমড়ামুখে বসে আছেন। কাছাকাছি বসে ফাইলের বিষয়বস্তু আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছু ঠাহর করা গেল না। আমার উপস্থিতিও যেন উনি টের পেলেন না।

একটু পরে ওঁর মুখ দিয়ে কী একটা কথা বেরুল। মনে হল বঙ্গভঙ্গ কিংবা এরকম কিছু। কথাটা উনি বিড়বিড় করে আওড়াতে শুরু করলে আর চুপ করে থাকা গেল না। বললাম, বঙ্গভঙ্গ ততো ১৯৪৭ সালে হয়ে গেছে। এতকাল বাদে ও নিয়ে দুঃখ করার কী আছে?

কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন এবার। ও তুমি এসে গেছ দেখছি ডার্লিং। তোমার কথাই ভাবছিলাম। একটু অপেক্ষা করো। কিছুক্ষণের মধ্যে এক ভদ্রলোক আসবেন এবং তোমার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য কিছু মালমশলা তার কাছে পেয়ে যাবে।

একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, আজ আমার ছুটির দিন। খবরের কাগজের জন্য আজ আমার এতটুকু মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আপনি হঠাৎ বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বিড়বিড় করে মরাকান্নার মতো শোকপ্রকাশ করছিলেন কেন?

বঙ্গভঙ্গ? কর্নেল ভুরু কুঁচকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর জোরে হেসে বললেন, না জয়ন্ত। রঙ্গো রঙ্গে। কোহাও রঙ্গে রঙ্গো।

তার মানে?

স্পিকিং উডস। কথা বলা বন। প্রশান্ত মহাসাগরের পলিনেশীয় এলাকার ছোট্ট দ্বীপ ইস্টার আইল্যান্ডের লুপ্ত ভাষায় কোহাও রঙ্গো রঙ্গো মানে যে বন কথা বলতে পারত।

এই সময় ষষ্ঠীচরণ এসে খবর দিল, এক সায়েব এসেছেন। তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা করে নিয়ে এলেন কর্নেল। তারপর পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার সঙ্গে। সায়েবের নাম কাপ্তেন জর্জ ব্যুগেনভিলি। সওদাগরী জাহাজে সারা পৃথিবী চক্কর মেরেছেন। নামটা শুনে বললাম, আপনার নামের সঙ্গে কি বুগানভিলিয়া ফুলের কোনও সম্পর্ক আছে?

সায়েব আমুদে স্বভাবের মানুষ। গড়ন প্রকাণ্ড কুমড়োর মতো। উঁড়ি দুলিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, আলবৎ আছে। বুগানভিলিয়া ফুল আসলে পলিনেশীয়। ১৭৬৮ সালে আমার মতো এক কাপ্তেন আঁতোয়াঁ দ্য বুগেভিলি ওই এলাকার একটা দ্বীপে এ ফুল আবিষ্কার করেন। ইউরোপে নিয়ে যান। তার নামেই ফুলের নাম চালু হয়।

কর্নেল যোগান দিলেন, উষ্ণ নিরক্ষরেখা অঞ্চলের উদ্ভিদ। নিস্টাজিনিসিয়া গোত্রের প্রজাতি।

মুচকি হেসে বললাম, কির্নেল, আপনার কোহাও রঙ্গো রঙ্গোর সঙ্গে বুগানভিলিয়া ফুল এবং মাননীয় অতিথি কাপ্তেন সায়েবের নামের এই যোগাযোগ সম্ভবত আকস্মিক নয়। তাই না?

কর্নেল সেই ফাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। কাপ্তেন ঝুগেনভিলি সেটার দিকে চোখ। বুলিয়ে বললেন, রাতারাতি জেরক্স কপি তৈরি দেখছি! কর্নেল, আপনার এই উৎসাহ দেখে আমার আশা হচ্ছে, এতদিনে কিওটা দ্বীপের বৃক্ষরহস্য ফাঁস করাটা আর কঠিন হবে না।

ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি রেখে গেল। ওঁরা কফি খেতে খেতে কথা বলছিলেন। আমি ফাইলে চোখ রাখলাম। তারপর যত পাতা ওল্টাই, তত চমক জাগে। একি সত্যি, না নিছক গালগল্প?

…তিন বছর আগে তাহিতি থেকে অস্ট্রেলিয়া হয়ে ফেরার সময় ইচ্ছা ছিল কিওটা দ্বীপ সম্পর্কে খোঁজখবর নেব। কিন্তু কোকোস দ্বীপপুঞ্জ এলাকা যেন গোলকধাঁধা। তার ওপর উল্টো বাতাস। এগোনো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। এ দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান ভারত মহাসাগরে। অক্ষাংশ ২০ ডিগ্রি, দ্রাঘিমাংশ ৮০ ডিগ্রি। পঞ্চাশ নটিকাল মাইল দূরত্বে পৌঁছতেই হঠাৎ প্রবল দক্ষিণগামী বাতাস আমার জাহাজ এনডেভার কে ঠেলে দিল বিপরীত পথে। চাগোস দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখান থেকে মরিশাস হয়ে কেপটাউন। তারপর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলাম। লন্ডনে পৌঁছে কিছুকাল মিউজিয়াম এবং লাইব্রেরি ছুঁড়ে কিওটা দ্বীপের রহস্য নিয়ে মাথা ঘামালাম…

সিঙ্গি ট্রিজ! সঙ্গীতকারী বৃক্ষ! কী অদ্ভুত কথা! অসংখ্য নাবিক এই উদ্ভট গল্পে বিশ্বাস করে। নিশ্চয় কানের ভুল। গাছপালার ফাঁক দিয়ে বাতাস বইলে অনেক সময় গানের সুর বলে ভুল হতে পারে। কিন্তু ঐতিহাসিক দলিলপত্রে দেখলাম, কিওটার গাছগুলো নাকি কথাও বলতে পারে।

আমার এবারকার অভিযান আন্টার্কটিকায়। নাবিকদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাগোেস থেকে দক্ষিণে। না এগিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে কোকোসের দিকে এগিয়েছিলাম। কাল সন্ধ্যায় কিওটার একমাইল দূরে নোঙ্গর বেঁধেছি আমার রেজিলিউশান জাহাজকে। ২৪ নভেম্বর কেপটাউন ছেড়েছি। আজ ১২ ডিসেম্বর। আবহাওয়া চমৎকার নাতিশীতোষ্ণ এখানে। সকালে একটা বোট নিয়ে তিনজন দ্বীপের দিকে এগিয়ে গেলাম। চমৎকার বেলাভূমি। ডাঙায় পৌঁছেই আমার যা অভ্যাস—বক ছুড়লাম একবার। তারপর ইউনিয়ন জ্যাক পুঁতে দিলাম। সমুদ্রপাখিরা কলরব করে উড়ে গেল। নিশ্চয় দ্বীপটাতে মানুষ বাস করে না। তাহলে বন্দুকের শব্দ শুনে তারা ছুটে এসে ভিড় করত। ডাক্তার স্মিথকে বললাম, চলুন তা হলে। ডাঃ স্মিথ কান খাড়া করে কী শুনছিলেন। বললেন, কে যেন চিৎকার করে কিছু বলল। হাসতে হাসতে উঁচু জায়গাটাতে উঠে গেলাম। আমার পেছনে ডাঃ স্মিথ আর দুজন সশস্ত্র নাবিক। সামনে ঘন জঙ্গল। বিশাল উঁচু সব অপরিচিত গাছ। স্বীকার করছি, গাছগুলো দেখে কেমন গা ছমছম করছিল। যেন তারা প্রাণীর মতো সচেতন এবং আমাদের নিঃশব্দে লক্ষ্য করছে। সেই গাছপালার ভেতর দিয়ে কয়েক পা এগিয়েছি, ঠিক যেন বাতাসের শব্দে শনশন করে কোথায় একদল মানুষ ইংরেজি ভাষায় গর্জন করে উঠল স্টপ ইট!… স্টপ ইট।

নিশ্চয় কানের ভুল। তারপর আর কোনও ভূতুড়ে আওয়াজ আমি শুনিনি। কিন্তু নাবিকরা আর এক পা বাড়াতে রাজি নয়। তারা আমাকে অগ্রাহ্য করে বোটে গিয়ে বসে রইল। ডাঃ স্মিথ আর আমি সতর্কভাবে ছোট্ট দ্বীপটা দুপুর পর্যন্ত ঘুরলাম। জনপ্রাণীটি নেই। ফেরার সময় ডাঃ স্মিথ বললেন, একবার যেন কাদের অস্পষ্ট ফিসফিস কথাবার্তা শুনেছেন। ভদ্রলোক বড় কল্পনাপ্রবণ।…

এখন রাত দশটা। রেজিলিউশন দক্ষিণ মহসাগরে ভেসে চলেছে আন্টার্কটিকার দিকে। কিওটা দ্বীপের ব্যাপারটা গাছপালার মর্মরধ্বনি ছাড়া আর কিছু নয়। আমার ধারণা, স্টপ ইট কথাটা কানের ভুল, সম্ভবত কাঠঠোকরা জাতীয় পাখি শুকনো কাঠে ঠোকরাচ্ছিল এবং তা থেকেই ওই আওয়াজ। বিদ্রোহী নাবিক দুজনকে শাস্তি দিয়েছি। পাঁচ ঘা বেত এবং ২৪ ঘন্টা অনাহারের শাস্তি। ডাঃ স্মিথ একটু আগে বলে গেলেন, ওদের গায়ে নাকি সবুজ রঙের অদ্ভুত অ্যালার্জি বেরিয়েছে। সবকাজেই ওঁর বাড়াবাড়ি।–ক্যাপ্টেন টমাস কুকের লগবুক। 12. 12. 1772

***

কীলিং (Keeling) দ্বীপপুঞ্জে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর ফসিল খুঁজতে যাওয়ার সময় দ্বীপের এক বৃদ্ধ আমাকে কিওটা নামে অদ্ভুত একটা দ্বীপের কথা বলে। সেটা নাকি মাইল ষাটেক দক্ষিণে। সেই দ্বীপের গাছগুলো নাকি কথা বলে। অবান্তর ব্যাপার। সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বিগল জাহাজের ক্যাপ্টেন রবার্ট ফিরয় বদরাগী মানুষ। এমনিতেই আমার কাণ্ডকারখানা দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে আছেন। তাকে যদি বা রাজি করাতে পারি, নাবিকদের পারব না। কিওটার কথা শুনেই তারা বলেছে, ওই ভূতের দ্বীপ অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত তাই কিওটা যাওয়া হল না। মনে ক্ষোভ রয়ে গেল।

— চার্লস ডারউইন, এইচ এম এস বিগল 23, 2, 1835

***

উদ্ধারপ্রাপ্ত নাবিকের নাম জন হিক্স। তাকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে ভারত মহাসাগরে জাহাজ ড়ুবি হয়ে একটা দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে গাছপালা কথা বলে। তাকে খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল একটা গাছ। হিক্সের বিবৃতির সময় প্রখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড হোম উপস্থিত ছিলেন। তিনি কোনও মন্তব্য করেননি। হিক্স আরও একটা অদ্ভুত কথা বলে। একটা গাছের সঙ্গে তার নাকি বিয়েও হয়েছিল। ডাক্তারদের মতে লোকটি উন্মাদ রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তবে ব্রিটিশ জাদুঘরের কিউরেটারে ডঃ ফক্স বলেছেন, খ্রিস্টপূর্ব একহাজার অব্দে ফিনিসীয় নাবিকদের প্যাপিরাসে লেখা যে লগবুক আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে গর্জনকারী গাছের কথা আছে। কোনও সমুদ্রে একটি দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা সেই ভৌতিক গর্জন শুনতে পেত। তাই দ্বীপে নামার সাহস পেত না। ডঃ ফক্স আরও বলেছেন, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে লেখা গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস সঙ্গীতকারী বৃক্ষের কথা বলেছেন। চৌদ্দ শতকে বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো লিখেছেন, ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গভীর রাত্রে তারা সেখানে কোলাহল শুনতে পান। জাহাজ দ্বীপের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সারারাত আশ্চর্য সব শব্দ শোনেন। সকালে পোললা বোটে করে দ্বীপটিতে পৌঁছন। কিন্তু আর একপা এগোতে পারেননি। প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয় এবং হাজার হাজার মানুষ যেন তাঁকে গর্জন করে এগোতে নিষেধ করে। পোললা লিখেছেন, গাছগুলো থেকেই ওই গর্জন ভেসে আসছিল। বোটে ফিরে গেলে, আশ্চর্য ব্যাপার ঝড়টা তক্ষুনি থেমে যায়।…

—দি ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড, লন্ডন 7.9. 1981

***

…কোহাও রঙ্গে রঙ্গো। কথা বলা বন। প্রশান্ত মহাসাগরের পলিনেশীয় এলাকার ছোট্ট দ্বীপ ইস্টার আইল্যান্ডে বিশপ জোসেন নামে এক খ্রিস্টীয় যাজক গত শতকে একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন। তাঁর লিপির সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার লিপির আশ্চর্য মিল। মেতেরো নামে তার স্থানীয় এক ভৃত্য পুঁথিটি পড়ে অনুবাদ করে দেয়। এই পুঁথির নাম কোহাও রঙ্গে রঙ্গো। এটি ইস্টার দ্বীপের আদিম অধিবাসীদের ধর্মীয় পুরাণ। এতে আছে এক অদ্ভুত বনের কাহিনী—যার গাছগুলো কথা বলতে পারত। তাদের উপাস্য দেবতার নাম ছিল রাঙ্গেতিয়া। তিনি আকাশের দেবতা। তার আশীর্বাদে গাছপালা কথা বলত মানুষের ভাষায়। বিশপ জোসেনের ধারণা, সেই কথা বলা বন বহু বছর আগে নির্মূল হয়ে গেছে কোনো কারণে।

-ইস্টার আইল্যান্ডের রহস্য : ই ডলফার, পৃষ্ঠা 5

প্যারিস ২০ জানুয়ারি—সম্প্রতি প্রখ্যাত অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন জর্জ ব্যুগেনভিলি তার সপ্তদশ নৌ অভিযানে আন্টার্কটিকা যাওয়ার সময় ঝড়ের মুখে পড়েন। জাহাজ ড়ুবে যায়। লাইফবোটের সাহায্যে ভাসতে ভাসতে সাত দিন পরে কোকোস দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপে ওঠেন। ক্যাপ্টেন ব্যুগেনভিলি জনহীন দ্বীপ থেকে গাছ কেটে ভেলা তৈরি করে সমুদ্র পাড়ি দেন। একমাস পরে কীলার দ্বীপে পৌঁছন। তিনি সেই নির্জন দ্বীপ সম্পর্কে এক অদ্ভুত বিবরণ দিয়েছেন। সেখানে নাকি গাছপালা মানুষের মতো কথা বলতে পারে।…

–রয়টার

ফাইল থেকে মুখ তুলে জর্জ ব্যুগেনভিলির দিকে তাকালাম। সায়েব মিটিমিটি হাসছিলেন।

 ০২. উদ্ভিদের গোপনকথা

আমার বৃদ্ধ বন্ধুকে ইদানীং ক্যাকটাস এবং অর্কিড-জাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে কী সব বিদঘুটে ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেখতাম। একদিন গিয়ে দেখি, হেড-ফোন মাথায় এঁটে বসে আছেন এবং একটা অ্যামপ্লিফায়ার যন্ত্রের নব ঘোরাচ্ছেন। একটা অদ্ভুত আকৃতির নধর ক্যাকটাসের গায়ে পিন ফুটিয়ে রেখেছেন। পিনের মাথায় সূক্ষ্ম তামার তার বাঁধা। তারটা আরও একটা ক্ষুদে যন্ত্রের ভেতর দিয়ে এসে অ্যামপ্লিফায়ারে পৌঁছেছে। ক্ষুদে যন্ত্রটা জারে তরলপদার্থের ওপর ভাসছে। তারপর অবাক হয়ে দেখি, উনি চোখ বুজে থিরথির করে কাঁপতে লাগলেন। অমনি ভাবলাম, এই রে! বুড়ো নির্ঘাৎ তড়িতাহত হয়ে পড়েছেন।

যেই না মনে হওয়া, দৌড়ে গিয়ে মেন সুইচ অফ করে দিলাম। হাঁফাতে হাঁফাতে ফিরে এসে রুদ্ধশ্বাসে বললাম, কর্নেল! কর্নেল! আপনি সুস্থ তো?

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার গর্জন করে উঠলেন, শাট আপ ইউ ফুল!

কস্মিনকালে ওঁর কাছে এমন ধমক খাইনি। আমি তো থ! একটু পরে অভিমান দেখিয়ে বললাম, বা! এই আপনার কৃতজ্ঞতাবোধের নমুনা! ইলেকট্রিক শক খেয়ে থিরথির করে কঁপছিলেন। এতক্ষণে অক্কা পেয়ে যেতেন। বাঁচিয়ে দেওয়াটা বুঝি অন্যায় হল? ঠিক আছে এবার খাবি খেতে দেখলেও মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব-তবে না আমার নাম জয়ন্ত!

কর্নেল তখন ফিক করে হেসে ফেললেন। উত্তেজিত হয়ো না ডার্লিং! তোমার কোনও দোষ নেই। ষষ্ঠীচরণ! ও ষষ্ঠি! ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ পর্দা তুলে মুখ বের করলে বললেন, মেন সুইচটা অন করে দাও। আর শোনো, ঝটপট আমার তরুণ বন্ধুর জন্যে কড়া করে কফি বানাও।আমিও খাব।

শান্ত হয়ে বসলে বললেন, জয়ন্ত! ওই মেক্সিকান ক্যাকটাসের সঙ্গে আমি একটু বাতচিত করছিলাম।

অবাক হয়ে বললাম, বলেন কী!

হ্যাঁ ডার্লিং! আচার্য জগদীশ বোসের যুগান্তকারী আবিষ্কারের পর অনেকগুলো দশক কেটে গেল। এখন বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, উদ্ভিদের শুধু সুখদুঃখের অনুভুতি নয়, সাড়া দেওয়ার শক্তি আছে। সেই সাড়া দেওয়াটাকেই বলব উদ্ভিদের ভাষা। ভাষাটা কিন্তু শব্দ দিয়ে নয়, কম্পন দিয়ে তৈরি। বিভিন্ন স্তরে সূক্ষ্ম-অতিসূক্ষ্ম কম্পনে তার কথা প্রকাশ পায়। এই ক্যাকটাসটা সবে কথা বলতে শুরু করেছিল এবং আমিও তার ভাষায় জবাব দিচ্ছিলাম—হঠাৎ তুমি এসে সবটাই ভেস্তে দিলে।

হাসতে হাসতে বললাম, আপনাকে হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কঁপতে দেখছিলাম। কী আশ্চর্য! ওভাবেই বুঝি গাছপালার সঙ্গে কথা বলতে হয়?

কর্নেল জারে ভাসমান ক্ষুদে যন্ত্রটা দেখিয়ে বললেন এটা একটা গ্যালভানোমিটার। তুমি লাই-ডিটেক্টর যন্ত্রের কথা জানো—যা অপরাধী সত্য বলছে, না মিথ্যে বলছে, ধরিয়ে দিতে পারে। এটা তারই একটা অংশ। এর ভেতর একটুকরো গ্র্যাফ-পেপার আছে এবং একটা সূক্ষ্ম পেন্সিলের শিস আছে। গত শতকের শেষভাগে ভিয়েনার এক ধমর্যাজক ফাদার ম্যাক্সিলিয়ান হেল এর উদ্ভাবক। পরে ইতালীয় বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানি প্রাণীজ বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে যন্ত্রটা আরও উন্নত করেন। তাঁর নামে যন্ত্রটার নাম দেওয়া হয় গ্যালভানোমিটার। আরও পরে ইংরেজ বিজ্ঞানী স্যার চার্লস হুইটস্টোনের আবিষ্কৃত বিদ্যুৎ সার্কিট হুইটস্টোন ব্রিজ পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়েছে। তবে…?

বাধা দিয়ে বললাম, কিচ্ছু বুঝব না। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম না।

তা হলে গাছের পাতা নিয়ে ব্যাকস্টার নামে এক বিজ্ঞানীর পরীক্ষার কথা শোনো! তিনি অসংখ্য পরীক্ষার পর বলেছিলেন, উদ্ভিদেরা চক্ষু ছাড়াই দেখতে পায়—মানুষ যতটা দেখতে পায়, তারও বেশি। উদ্ভিদের যেন মন আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, সে এই বিশাল প্রাণীজগতের অন্যতম শরিক এবং সে সব প্রাণীর মনের কথা টের পায়।

সেই ব্যাকস্টার সায়েব বলেছেন এ কথা? আমি হাঁদারামের মতো তাকিয়ে বললাম। সর্বনাশ! যখন আপনার বাসায় আসি, ওইসব বিদঘুটে গড়নের উদ্ভিদগুলোকে দেখে মনে মনে কত হাসি এমনকী, একদিন আপনার পরীক্ষিত ওই অষ্টাবক্র ক্ষুদে উদ্ভিদটিকে দেখিয়ে যেদিন ষষ্ঠীচরণকে বলছিলাম, ব্যাটা যেন সার্কাসের ক্লাউন! ওরে বাবা! তা হলে তো ও বেজায় রাগ করছিল আমায় ওপর!

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, এই যে এখন তুমি এসেছ এবং তার কথাবার্তায় বাধা দিয়েছ, এতে ও কি ক্রুদ্ধ না হয়ে পারে?

কাছে গেলে প্যাঁক করে কাটা ফুটিয়ে দেবে বুঝি?

তা হয়তো দেবে না। কিন্তু তুমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রোড থেকে বিকিরণ বেড়ে গিয়েছিল এবং গ্যালভানোমিটার কাপছিল। একমিনিট। গ্রাফটা বের করি।

কর্নেল ক্ষুদে যন্ত্র থেকে একটুকরো কাজ বের করে দেখালেন। অসংখ্য আঁকাবাঁকা রেখা জটিল হয়ে আছে দেখলাম। বললাম, এই বুঝি ওর রাগের ভাষা?

কর্নেল আমার তামাশায় কান না দিয়ে বললেন, এই কাগজটার নাম পলিগ্রাফ। বিখ্যাত ব্যাকিস্টার এক্সপেরিমেন্টের সূত্র ধরে আমি এই জটিল রেখাগুলোকে বিশ্লেষণ করতে পারি। এগুলো কোড ল্যাঙ্গেয়েজ অর্থাৎ সাংকেতিক ভাষা। কোডগুলোকে শ্ৰেণীবদ্ধ করে অর্থোদ্ধার করা সম্ভব। যাই হোক, আপাতত কফি খাও। তারপর দুই বিজ্ঞানী স্যাক্স রোমার এবং বুলওয়ার লিটনের পরীক্ষার গল্প বলব। সে আরও বিচিত্র ঘটনা। তারা আমেরিকার নিউ জার্সিতে একটা কারখানার কাছে খুন হওয়া একটি মেয়ের খুনিকে ধরিয়ে দিতে পেরেছিলেন!

আপনার মতো তারা শখের গোয়েন্দাও ছিলেন বুঝি?

না, জয়ন্ত। ওঁরা নিছক বিজ্ঞানী। পদার্থ এবং জীববিদ্যার চর্চা করতেন। যেখানে মেয়েটি খুন হয়েছিল সেখানে ছিল একটা বুনো আপেল গাছ। গাছটাই ধরিয়ে দিয়েছিল খুনিকে।

চেঁচিয়ে বলেছিল পাকড়ো! পাকড়ো!

তামাশা নয়, ডার্লিং! এটা বাস্তব ঘটনা। একটুকরো পলিগ্রাফ আর একটা গ্যালভানোমিটার, একটা ইলেকট্রোড—ব্যস! এ তিনটি জিনিস গাছটার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে লোক জড়ো করা হয়েছিল গাছটার সামনে। একবার করে পাতা ছুঁয়ে যেতে বলা হয়েছিল প্রত্যেককে। তারপর দেখা গেল, একজনের ছোঁয়ার পর পলিগ্রাফে গাছটা তীব্রভাবে সাড়া দিয়েছে। কম্পনরেখা বিশ্লেষণ করে বোঝা গেল, সেই লোকটাই খুনি।

সেদিন কর্নেল সারাবেলা এইসব উদ্ভুট্টে কথাবর্তা বলেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, জয়ন্ত, তুমি ই এস পি কথাটা কি শুনেছ?

শুনেছি। এক্সট্রা সেনসরি পার্সেপসন। অর্থাৎ অতিরিন্দ্রিয় অনুভূতি।

উদ্ভিদের মধ্যে ই এস পি অধুনা সুপ্রমাণিত। তারা এমন জিনিস দেখতে পায় এবং বুঝতে বা জানতে পারে—যা আমরা দেখতে পাই না ও জানি না। ডার্লিং! আচার্য জগদীশ বসু যেখানে শুরু করেছিলেন, সেখান থেকে একালের সব উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর হাতেখড়ি। তোমার এত বেশি অবাক হওয়ার কারণ নেই। তামাশা করাও শোভা পায় না। আচার্য জগদীশচন্দ্র এই কলকাতারই মানুষ ছিলেন। তুমি কি তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা শোনোনি?

এই সব শোনার পর থেকে কর্নেলের বাসায় যখনই গেছি, ওঁর লালিত-পালিত উদ্ভিদ মশাইদের প্রতি সসম্ভ্রমে দৃষ্টিপাত করেছি। এমনকী একটা ক্যাকটাসকেও বলেছি, হ্যাল্লো, লিটলবয়! হাউ ড়ু ইউ ড়ু!

কর্নেলের সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎ চোখ গেছে ড্রয়িং রুমের কোনায় রাখা কয়েকটা টবের গাছের দিকে। অমনি বুকটা ধড়াস করে উঠেছে, যেন ক্যাটক্যাট করে তাকিয়ে আমাকে দেখছে –

মনের ভেতর কী যেন পেঁচানো মতলব পোষা!

স্বীকার করছি, গাছপালা অর্থাৎ উদ্ভিদ সম্পর্কে বুড়ো ভদ্রলোকটি আমার দৃষ্টিভঙ্গি আমূল বদলে দিয়েছিলেন যেন। রাস্তায় যেতে যেতে গাড়ি থামিয়ে কোনও বিশাল গাছের দিকে তাকিয়ে থেকেছি অবাক চোখে। তারপর মনে মনে বলেছি, হ্যাল্লো জেন্টলম্যান! ভাল আছেন তো? যেন মনে হত, বৃক্ষভদ্রলোক একটু করুণ হেসে বলছেন, খুব ভাল নয় মশাই! সি এম ডি এর হালচাল দেখে বড় তটস্থ আছি। কিছু বলা যায় না।

ঠিক এমনি করে চৌরঙ্গীতে টাটা বিল্ডিংয়ের সামনে একটা সুন্দর নাদুসনুদুস গড়নের বৃক্ষভদ্রলোক আমাকে ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন, দিনকাল ভাল না। আজ আছি, কাল নেই অবস্থা।

সে কী! কেন বলুন তো?

ওরা আসছে। পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। হাতে হাতে কুড়ুল। পেছনে পেল্লায় আর্থ এক্সক্যাভেটার গাড়ি!

কারা? কারা?

আবার কারা? পাতাল রেলের লোকেরা। আপনাদের মানুষ জাতটার ঠেলায় আমরা মশাই চিরকাল অস্থির। কোণঠাসা করতে করতে আমাদের শেষ করে ফেললেন প্রায়। বুঝবেন শেষে ঠ্যালাটা—যখন দেশটা মরুভূমি হয়ে যাবে।

সেই রবিবার কর্নেলের ঘরে জর্জ ব্যুগেনভিলির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর এই সব কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। কোকোস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত কিওটা দ্বীপের উদ্ভিদরহস্য আমাকে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিল। কোহাও রঙ্গে রঙ্গো—কথা বলা বন তা হলে সত্যি আছে পৃথিবীতে?

তা হলে সেখানে যেতে এতদিন বাধা কী ছিল বিজ্ঞানীদের? দ্বীপটা যখন সবাই চেনে তখন যায়নি কেন কেউ? আমার এসব প্রশ্ন শুনে ব্যুগেনভিলি বলেছিলেন, সমস্যা হল দ্বীপটা ঠিক কোথায় কেউ জানে না। কোকোস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত দ্বীপ বলা হয় বটে, কিন্তু যতবারই ওখানে

অভিযাত্রীদল গেছে, দুই দ্বীপপুঞ্জে তেমন কোনও অদ্ভুত দ্বীপ দেখতে পায়নি।

কিন্তু আপনি গিয়েছিলেন!

হ্যাঁ। কিন্তু সে তো ভাসতে ভাসতে দৈবাৎ গিয়ে পড়েছিলাম। উদ্ধার পাওয়ার পর জাহাজ নিয়ে গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে সেটাকে আর আবিষ্কার করতে পারিনি। এটাই আসল রহস্য।

তা হলে কোকোস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত বলা হয় কেন? ওখানকার আদিম অধিবাসীরা দাবি করে, কিওটা তাদেরই প্রতিবেশী। প্রাচীন যুগে তাদের রাজার রাজধানী ছিল ওই দ্বীপে। কিন্তু মুশকিল হল, ৮০° দ্রাঘিমাংশ এবং ২০° অক্ষাংশে ছোটবড় দ্বীপের সংখ্যা প্রায় এক হাজারেরও বেশি। বারো হাজার বর্গমাইল জুড়ে ছড়িয়ে আছে তারা। মাত্র দুটো দ্বীপে বসতি আছে—বাকিগুলো জনহীন। কারণ সব দ্বীপই মানুষের বসবাসের অযোগ্য। অস্বাস্থ্যকর এবং মারাত্মক পোকামাকড়ের ডিপো। সে সব দ্বীপে যে যাবে, সাংঘাতিক ভাইরাসে সে সংক্রামিত হয়ে জটিল অসুখে মারা যাবে।

আপনি কি কর্নেলকে নিয়ে কিওটা দ্বীপ খুঁজতে বেরুনোর উদ্দেশ্যেই এসেছেন?

জয়ঢাক সায়েব হাসির মাঝে ঘর কাঁপিয়ে বললেন, তা ছাড়া আর কী?

কর্নেল সরকার আমার পুরনো বন্ধু! উদ্ভিদের গোপন কথা নামে ওঁর একটা প্রবন্ধ পেয়েই ছুটে এসেছি কলকাতায়।

০৩. কাত্তি! কাত্তি!

এপ্রিলের এক ঝরঝরে বৃষ্টিধোয়া বিকেলে কোকোসের ৭২নং দ্বীপ রুবি আইল্যান্ডে পৌঁছে মনে হচ্ছিল একি স্বর্গে এলাম? এ দ্বীপ যেন প্রকৃতি নিজের হাতে যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন। কত ফুল কত পাখি কত প্রজাপতি!

কর্নেলের আবার প্রজাপতির পেছনে ছুটোছুটির বাতিক আছে। কিন্তু আশ্বস্ত হয়ে লক্ষ্য করলাম, উনি জর্জ ব্যুগেনভিলির সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলতে ব্যস্ত। সামোয়া এই দোতলা হোটেলের নাম। দক্ষিণের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। অদূরে সাদা বালিতে ঢাকা বেলাভূমি। ভারত মহাসাগরের ব্যাকওয়াটার এখানে বেশ শান্ত ও ভদ্র। কারণ মাইলখানেক দূরে দ্বীপটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কোরাল রিফ বা প্রবাল-পাঁচিল। পাঁচিলে জায়গায় জায়গায় ভাঙন আছে। সেই ভাঙন দিয়ে সমুদ্রের জল গর্জন করতে করতে ব্যাকওয়াটারে ঢোকামাত্র শান্ত হয়ে যাচ্ছে।

দীর্ঘ জার্নিতে আমি ক্লান্ত। কলকাতা থেকে বিমানে জাকার্তা। জাকার্তা থেকে সামরিক বাহিনীর ছোট্ট একটা বিমানে এই রুবি দ্বীপে পৌঁছেছি। সরকার কিওটা-রহস্য নিয়ে বরাবর মাথা ঘামান। তাই সবরকম সাহায্য তাদের কাছে পাওয়া যাবে।

কফি এবং একজাতীয় সামুদ্রিক মাছের কেক খাওয়ার পর কর্নেল জয়ঢাক সায়েবকে নিয়ে কোথায় যেন বেরুলেন। বলে গেলেন, ঘন্টা দুই পরে ফিরব। তুমি ইচ্ছে করলে বিচে ঘোরাঘুরি করতে পারো—কোনও ভয় নেই। রুবি খুব নিরাপদ জায়গা।

আমার আঁতে লাগল। আমি বুঝি ভীতু মানুষ? ওঁরা সরকারি স্টেশনওয়াগন গাড়িতে রওনা হয়ে গেলে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। উঁচু-নিচু সুন্দর পাহাড়ি রাস্তায় ওঁদের গাড়িটা গাছপালার

আড়ালে চলে গেল। একানড়ের মতো নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম।

বিচে মানুষজন খুবই কম। নারকেল বীথির পাশে দাঁড়িয়ে আছি। তারপর দেখি, একটা বোর্ডে কয়েকটি ভাষায় লেখা আছে, সাবধান! সামনে বিপদ। আর এগোবেন না।

আমি তো হকচকিয়ে গেছি। বিপদ! কিসের বিপদ? হঠাৎ আমার কয়েক ইঞ্চি তফাতে গদাম করে একটা নারকেল পড়ল। ওমনি বিপদটা টের পেয়ে গেলাম। ওই প্রকাণ্ড ঝুনো নারকেল আমার মাথায় পড়লে এখনই অক্কা পেতে হত!

রাগ হল। কর্নেল যে বলে গেলেন, খুব নিরাপদ জায়গা! নারকেল গাছগুলো থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে বিচে বসে পড়লাম। সামনে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। দূরের প্রবাল-পাঁচিলটা ঝলমল করছে। আদিবাসীদের নৌকা কালো হয়ে ভেসে আছে কোথাও। ওরা হয়তো বেলা শেষে মাছ ধরতে বেরিয়েছে!

পায়ের শব্দে ঘুরে দেখি, একজন বুড়োমানুষ। তোবড়ানো গাল, চিনাদের মতো মুখ বেঁটে—কিন্তু কাঠামোটি চওড়া। তার মাথায় নীল টুপি দেখেই বুঝলাম, লোকটা জাহাজি। একটু হেসে সে বলল, স্পিক ইংলিশ?

কিছুক্ষণের মধ্যে আলাপ হয়ে গেল। বুড়ো একজন প্রাক্তন তিমিশিকারি। নাম রাজাকো। বাড়ি ছিল একসময় বান্দুং-এর ওদিকে একটা ছোট্ট শহরে। এখানে এখন সে স্থায়ী বাসিন্দা। বুড়ো হয়ে আর তিমিশিকারে যেতে পারে না। কাছাকাছি সমুদ্রে আজকাল তিমি মেলে না এবং শিকারেও কড়াকড়ি আছে। তিমি শিকারে যেতে হলে সুদূর দক্ষিণে আন্টার্কটিকার তুষার অঞ্চলে পাড়ি জমাতে হবে। অগত্যা সে মাছের কারবারে মন দিয়েছে।

রাজাকো বুড়োকে আমার খুব ভাল লাগছিল। আলাপী মানুষ। তিমিশিকারের মারাত্মক সব গল্প বলল। শেষে বলল, তুমি বুঝি বেড়াতে এসেছ এদেশে?

বললাম, হ্যাঁ। কতকটা তাই তবে…

আমাকে হঠাৎ থামতে দেখে রাজাকো বলল, ব্যবসা-ট্যবসা করারও ইচ্ছে আছে বুঝি? সে তো ভালই। তোমার মতো জোয়ান ছেলের কি শুধু টো টো করে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ালে চলে?

এই দেখো না! আমার যদি তোমার মতো একটা ছেলে থাকত, তাকে আমি এক্ষুনি আমার মাছধরা জাহাজে চাপিয়ে দক্ষিণ সাগরে তিমি মারতে পাঠাতাম। একটা ছোটখাটো তিমি মারতে পারলেই রাজা। প্রচুর চর্বি আর হাড় বেচে একদিনেই সে ধনী হয়ে যেত।

রাজাকোর বেশি কথা বলার বাতিক আছে। বললাম, না না। ব্যবসা আমার পোষাবে না। আমি এসেছি সরকারের একটা কাজে।

রাজাকো ভড়কে গিয়ে বলল, ওরে বাবা! তুমি সরকারি লোক? তা হলে তো তোমার সঙ্গে আমার বনবে না। সরকারি লোকেরা বড্ড বাজে।

বলেই সে উঠে দাঁড়াল। তারপর হনহন করে চলতে শুরু করল! অদ্ভুত বেয়াড়া লোক তো!

সন্ধ্যার ধূসরতা ঘনিয়েছে ততক্ষণে! একটু-একটু করে শীত করছে। প্রবাল-পাঁচিল ঘিরে কুয়াশা জমে উঠেছে। নারকেল বনটার পাশ দিয়ে রাজাকো হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। ভাবলাম, ওর ভুলটা ভাঙিয়ে দেওয়া দরকার।

কিন্তু কয়েক পা এগোতেই একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেল। নারকেল বনের ভেতর থেকে দুটো নোক এসে রাজাকোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর দেখলাম রাজাকো পড়ে গেল। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম মাতৃভাষায় এই! এই! খবর্দার!

লোক দুটো আমাকে দেখামাত্র নারকেল গাছের ভেতর দিয়ে পালিয়ে গেল। দৌড়ে রাজাকোর কাছে গিয়ে দেখি, সে মুখ খুঁজে পড়ে রয়েছে। তাকে চিত করে দিতেই আমার সারা শরীর আতঙ্কে হিম হয়ে গেল। তার পেটে ছোরা মেরেছে আততায়ীরা। রক্তে জামাপ্যান্ট ভেসে যাচ্ছে।

বিচ এখন একেবারে জনহীন। আমার সবচেয়ে আতঙ্ক হল এই ভেবে যে, এখন এ অবস্থায় আমাকে কেউ দেখলে আমাকেই খুনি ঠাওরাবে। পুলিশের হাঙ্গামায় পড়তে হবে। অতএব এখনই কেটে পড়া দরকার। বরং হোটেলে গিয়ে ম্যানেজারকে খবর দেওয়া ভাল যে বিচে একটা রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। তারপর ওরা যা হয় করবে।

উঠে পঁড়িয়েছি, সেই সময় রাজাকো ঘড়ঘড়ে গলায় অতিকষ্টে উচ্চারণ করল, কাত্তি! কাত্তি! তারপর একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওর শরীরটা স্থির হয়ে গেল।

কী বলল কে জানে! কাত্তি! কী? আমি আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালাম না। এমন হতে পারে, ওর দুই খুনিই এতক্ষণে খবর দিয়েছে যে একজন বিদেশি টাকা ছিনতাইয়ের লোভে রাজাকোকে খুন করেছে।

আমি পা বাড়াতেই শক্ত কিছুতে পা পড়ল। দেখি রাজাকোবুড়োর সেই নীল টুপিটা ছিটকে পড়ে রয়েছে। কিন্তু টুপিটা এত শক্ত ঠেকল কেন? হেট হয়ে টুপিটা তুলে নিলাম। তারপর অবাক হয়ে গেলাম। এতটুকু একটা চুপির ওজন এত। নিশ্চয় এর ভেতর কোনও ভারী ধাতব জিনিস আছে।

টুপিটা সঙ্গে সঙ্গে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম। তারপর অনেকটা ঘুরে বিচ এলাকা। পেরিয়ে হোটেলে পৌঁছলাম। রিসেপশনের ইন্দোনেশীয় মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল, কেমন লাগল আমাদের মিস রুবিকে?

সে এই রুবি দ্বীপের প্রশংসা শুনতে চাইছিল। কিন্তু এ অবস্থায় হাসিতামাশা করা অসম্ভব। বললাম, দেখুন, এইমাত্র বিচ থেকে আসছি। বিচে একটা লোক পড়ে আছে দেখলাম। ডাকলাম সাড়া দিল না। অন্ধকারে কিছু বোঝা গেল না। মনে হল…

নিশ্চয় কোনও মাতাল ট্যুরিস্ট।

তবু একটু খোঁজ নেওয়া দরকার নয় কি?

মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, আপনি ভাববেন না মিস্টার! বিচে এমন মাতাল পড়ে থাকা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের গা সওয়া। লোকটা যদি ট্যুরিস্ট না হয় তা হলে নিশ্চয় কোনও নাবিক। নাবিক যদি হয়, তা হলে আগামীকাল সূর্য ওঠার আগে ওর নেশা কাটবে না। ওকে ওঠানোও যাবে না।

আমার বিবেকে বাধছিল। বললাম, বরং পুলিশে খবর দিন না মিস…

আমার নাম তোতিলাবতী ত্রিসত্যজায়া।

এ যে ভারতীয় নাম!

ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলে আপনাদের সংস্কৃত ভাষার ছড়াছড়ি মিস্টার।…

আমার নাম জয়ন্ত চৌধুরি।

মিঃ চৌড্রি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

অদ্ভুত ব্যাপার তো! তেতিলাবতী ধরেই নিয়েছে আমি একটা বেহুঁশ মাতালকে দেখেছি। অগত্যা আর না বলে পারলাম না। মিস তোতিলাবতী…

আমায় তোতি বলে ডাকলে খুশি হব।

মিস তোতি! লোকটার গায়ে রক্ত আছে মনে হল। ওকে কেউ ছুরি মেরেছে!

তোতি এবার চোখ বন্ধ করে বলল, তাই বুঝি! তা হলে তো আগে কাউকে দেখতে পাঠাতে হয় ; তা না হলে পুলিশে খবর দিয়ে ঝামেলা হবে। বলে সে হোটেলের একজন লোককে ডেকে নিজের ভাষায় কিছু বলল। লোকটা আর একজনকে ডেকে নিয়ে টর্চ হাতে বেরিয়ে গেল।

ওপরে আমাদের ঘরে এসে টুপিটা বের করলাম। তারপর একটা ব্লেড দিয়ে চিরতেই বেরিয়ে পড়ল একটুকরো সঁাতলাধরা তামার ফলক। ফলকটা চাপরাসের মতো গোলাকার! তার ওপর আঁকাবাঁকা আঁচড় কেটে দুর্বোধ্য অক্ষরে কী সব লেখা রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে আকৃষ্ট করল ফলকের ঠিক মাঝখানে একটা অদ্ভুত গড়নের গাছ। গাছটার ডালে-ডালে ইংরেজিতে এ বি সি ডি এইসব অক্ষর আঁকা।

মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছিলাম না। কতক্ষণ পরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তারপর কর্নেল ও ব্যুগেনভিলি ফিরলেন। ঘরে ঢুকে কর্নেল বললেন, বিচে একটা রক্তাক্ত লাশ পেয়েছে পুলিশ। জয়ন্তকে আমি বলেছিলাম দ্বীপটা নিরাপদ। কথাটা খাটল না দেখছি। বলেই কর্নেলের চোখ পড়ল আমার হাতের ফলকটার দিকে। শ্বাসরুদ্ধ গলায় বললেন, এ তো দেখছি কাত্তি। কাত্তি তুমি কোথায় পেলে জয়ন্ত?

ব্যুগেনভিলি লাফিয়ে উঠলেন। কী আশ্চর্য! এ যে দেখছি একটা কাত্তি!

Exit mobile version