কর্নেল হাসতে লাগলেন। ব্যুগেনভিলি বললেন, বিচের ধারে গাছ থেকে নারকেল পড়ে অনেক সময় ভেঙে যায়। জোয়ারে সমুদ্র সেগুলো টেনে নেয়। তখন চিংড়িগুলো নারকেল শাঁস খেয়ে ফেলে। তাই এসব চিংড়ির মাংসে নারকেলের স্বাদ।
সেই অপূর্ব চিংড়ি-নারকেলের স্বাদের তুলনা নেই। তারিয়ে তারিয়ে খেতে দেখে কর্নেল মুচকি হেসে মন্তব্য করলেন, শোওয়ার সময় কিন্তু হজমি ট্যাবলেট খাওয়া দরকার… এ উপদেশ কানে না নেওয়ার ফলটা এ রাতে ভালই ভুগতে হল। শেষ রাতে ব্যুগেনভিলি একটা জব্বর ফরাসি ট্যাবলেট না খাওয়ালে কী ঘটত বলা কঠিন। সকালে যখন ওঁরা দুজনে ডঃ বিকর্নের বাড়ি গেলেন, তখন আমি শয্যাশায়ী। মন খারাপ হয়ে গেল। নটা নাগাদ উঠে দেখি, শরীর একেবারে ঘায়েল। এমন সময় নিচে থেকে মিস তোতি ফোন করে জানাল, একটি মেয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। খুব অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, পাঠিয়ে দিন।
একটু পরে বছর কুড়ি-বাইশের টুকটুকে ফর্সা একটি মেয়ে এসে ভারতীয় প্রথায় নমস্কার করে বলল, আমি রোমিলা। মিঃ রাজাকোর মেয়ে।…
০৫. রাজাকোর ঘরে হানা
রোমিলার পোশাকও একেবারে ভারতীয় মেয়েদের মতো। শাড়ি ও ব্লাউজপরা। শুধু খোঁপাটা মাথার মাঝখানে চুড়ো করে বসানো প্রাচীন যুগের মুনিকন্যাদের মতো। গলায় সেইরকম রুদ্রাক্ষের মালা।
আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে ইংরাজিতে সে বলল, আপনি নিশ্চয় অবাক হয়েছেন। আমার হতভাগ্য বাবার নাম রাজাকো বাদান, কাল যাঁকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে আপনারই সামনে!
দুঃখিতভাবে বললাম, কথাটা ঠিকই মিস রোমিলা! কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। দুজনের মধ্যে তখন প্রায় অড়াইশো গজ দূরত্ব। তা ছাড়া সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। আমি দৌড়ে যেতে যেতে খুনিরা পালিয়ে যায়।
রোমিলা বলল, না মিঃ চৌড্রি! আমি কোনও অভিযোগ নিয়ে আপনার কাছে আসিনি। এ সামোয়া হোটেলের রিসেপশনিস্ট তোতিলাবতী আমার বন্ধু। তার কাছেই আপনার কথা কাল রাতে শুনেছি। তোতিও খুব পস্তাচ্ছে। সে প্রথমে নাকি আপনার কথায় গুরুত্ব দেয়নি। আসলে বাবার খুবই বদনাম ছিল এখানে।
আগে আপনি বসুন প্লিজ।
রোমিলা বসে বলল, আপনার সঙ্গী ভদ্রলোকেরা নিশ্চয় ডঃ বিকর্ণের বাড়ি গেছেন?
আপনি কীভাবে জানলেন?
রোমিলা একটু হাসল। ডঃ বিকর্ণ যখন জাকার্তার বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যার প্রধান অধ্যাপক ছিলেন, তখন আমি তার ছাত্রী ছিলাম। উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। সত্যি বলতে কী, আমারই তাগিদে উনি কোকোসে এসে স্থায়ীভাবে বাড়ি করে বাস করছেন। ওঁকে বলেছিলাম, আমাদের এসব দ্বীপে উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণার প্রচুর সুযোগ আছে। আমি ওঁকে সাহায্য করতে পারি।
খুব আগ্রহ জাগল রোমিলা সম্পর্কে। বললাম, আপনি এখন কী করেন?
রোমিলা বলল, আমার দুর্ভাগ্য মিঃ চৌড্রি! জাকার্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মা মারা যান। বাবা অসহায় হয়ে পড়েন। তাই বাধ্য হয়ে পড়াশুনো ছেড়ে ফিরে আসি এখানে। বাবার একমাত্র সন্তান আমি। ওঁর মাছের কারবার দেখাশোনা করছি এই একটা বছর। এর মধ্যে ডঃ বিকর্ণ রিটায়ার করে চলে আসেন আমার কথামতো। কিন্তু আমি ওঁর কোনও কাজে লাগবার সময়ই আর পাইনি। বাবা উড়নচণ্ডী মানুষ। খালি টো টো করে ঘুরে বেড়াতেন। তাই আমাকে সব দেখাশুনো করতে হয়েছে।
রোমিলার কণ্ঠস্বর সুমিষ্ট এবং আচরণ খুব নম্র। বললাম, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভাল লাগল রোমিলা! বিশ্বাস করুন, আপনার বাবার ব্যাপারটাতে…
কথা কেড়ে রোমিলা বলল, বুঝতে পারছি। কিন্তু কীভাবে বাবাকে ওরা খুন করল, আপনার মুখ থেকে জানার জন্যেই এসেছি মিঃ চৌড্রি। রুবি দ্বীপের পুলিশ মাথা ঘামাবে না জানি। বিশেষ করে আমার বাবার জুয়াড়ি মাতাল বলে ভীষণ বদনাম ছিল। আপনি কি দয়া করে কী ঘটেছিল বলবেন?
পুরো ঘটনা সবিস্তারে বললাম। শোনার পর রোমিলা চাপা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
কাত্তি শব্দটা বাবার মুখে শুনেছি। ঘুমের ঘোরে উচ্চারণ করতেন। পরে জিজ্ঞেস করলে বলতেন ও কিছু না। তা হলে দেখছি, মৃত্যুর মুহূর্তে বাবা কাত্তি শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন! আচ্ছা মিঃ চৌড্রি, কাত্তি জিনিসটা কী?
ওকে বলিনি যে, রাজাকোর টুপি আমি কুড়িয়ে এনেছিলাম এবং টুপির ভেতরে সত্যি কাত্তি পেয়েছি। বললাম, শুনেছি কাত্তি হল প্রাচীন পর্তুগিজ জলদস্যুনেতার তামার পদক। ফলকও বলতে পারেন। যে দস্যুনেতা একশো জাহাজ লুঠ করতে পারত, সে ওই পদক গলায় ঝুলিয়ে রাখত।
রোমিলার জন্যে ফোনে নিচের ক্যান্টিনে কফির অর্ডার দিলাম। রোমিলা অন্যমনস্ক রইল কিছুক্ষণ তারপর ফের চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবা মারা গেছেন। তাই আপনাকে জানাতে বাধা নেই। ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা জলদস্যুদের দলে ছিলেন একসময়।
উত্তেজনা চেপে রেখে বললাম, তাই বুঝি? আমাকে বলছিলেন, তিমিশিকার করে বেড়াতেন আন্টার্কটিকায়।
সে অনেক পরে। রোমিলা হঠাৎ আমার চোখে চোখ রেখে বলল, মিঃ চৌড্রি কি বলবেন আপনাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য নিছক বেড়ানো—নাকি অন্য কিছু?
কেন এ প্রশ্ন?
আপনার সঙ্গীরা কাল বিকেলে ডঃ বিকর্ণের বাড়ি গিয়েছিলেন মিলিটারি গাড়িতে। সকালেও ফের গেলেন দেখলাম। তাই সন্দেহ জাগছে।
কিসের সন্দেহ?
আমাদের সরকার ডঃ বিকর্ণকে বহুদিন আগে কিওটা নামে এক ভূতুড়ে দ্বীপের স্পিকিং উডস অর্থাৎ কথা বলা বনের রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব দিয়েছেন। ডঃ বিকর্ণ নিজেই আমাকে বলেছেন একথা। উনি সরকারি অর্থসাহায্যে এ নিয়ে রিসার্চ করছেন। আমাকে ওঁর অ্যাসিন্ট্যান্ট হওয়ার কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম কথা, আমার যোগ্যতা কম। দ্বিতীয় কথা, বাবার মাছের কারবার নিয়ে আমি ভীষণ জড়িয়ে আছি।