হ্যাঁ, এখানে পাখির ডিম প্রচুর। সমুদ্রের স্বচ্ছ জলে মাছও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কঁচা খাব কেমন করে? একটু পরে ভাবলুম, বরং ওদের জাহাজ চলে গেল আবার সাঁতার কেটে দ্বীপে ফিরে যাব। ক্যারিবোদের জিনিসপত্র কাল রাতের ঝড়ে উড়ে কোথাও পড়ে আছে। ওর ভেতর যদি একটা সিগারেট লাইটার পেয়ে যাই, তাহলে অন্তত মাছের রোস্ট খেয়েও বেঁচে থাকতে পারব।
কিন্তু দ্বীপে তো সব পুড়ে ছাই। আগুন জ্বালাব কিসে? আমার মনটা দমে গেল। এদিকে খিদেও পেয়েছে। একটা ডিম ভেঙে চোখ বুজে চোঁ-চোঁ করে গিলে ফেললুম। খিদের মুখে অমৃত লাগল। আরও গোটা তিনেক ডিম গিলে খিদেটা যদি বা দূর হল জলের তেষ্টা মেটাব কেমন করে? ঝরনা আছে কিওটা দ্বীপের পাহাড়ে। এখানে প্রবাল বলয়ের দুধারে নোনা জল।
চাতালের ওপর ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ মনে হল, কোনও গর্তে বৃষ্টির জল কি জমে নেই? মাউন্টেনিয়ারিং-এ ট্রেনিং নেওয়াটা এতকাল পরে দারুণ কাজে লাগল। অনেক খুঁজে একখানে গর্তের ভেতর জল পাওয়া গেল। জলটা চেখে একটু ঝাঁঝালো স্বাদ পেলুম। বিষাক্ত নয় তো? ভয় পেয়ে মুখে দিলুম না। প্রবাল অশোধিত অবস্থায় বিষাক্ত বলে শুনেছি। তবে এই পাঁচিল প্রবালকীট জমে তৈরি হলেও এর বয়স হাজার-হাজার বছর। এখন পাথরে পরিণত হয়েছে। কাজেই এখানে। প্রবালের বিষ না থাকাই সম্ভব। তবু মনে সন্দেহ এসেছে যখন না খাওয়াই ভাল। অগত্যা বৃষ্টি-মেঘের আশায় তাকিয়ে রইলুম।
বৃষ্টি এল বিকেল নাগাদ। তুমুল বৃষ্টি। ছেড়া জামা নিংড়ে জল খেলুম। সেই গুহার ভেতর কাটিয়ে দিলুম একটা রাত। পরদিন সকালে পাঁচিলের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে দেখি, দ্বীপের বিচে। মোটরবোটগুলো নেই। দূরের সমুদ্রে কিয়াংয়ের জাহাজটাকেও দেখতে পেলুম না। ওরা তাহলে গুপ্তধন উদ্ধার করে কখন ফিরে গেছে।
সাঁতার কেটে দ্বীপে ফিরে এলুম আবার।
দ্বীপ নয়, শ্মশান। ক্লান্ত, দুঃখিতভাবে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় বেহালা বেজে উঠল। সেই একলা বেহালা-বাজিয়ে গাছটা বেঁচে আছে শুধু। করুণ সুরে একলা বেহালা বাজাচ্ছে। তার কাছে। গিয়ে দাঁড়ালুম। কিওটার শ্মশানে দাঁড়িয়ে সে শোকসঙ্গীত বাজিয়ে চলেছে একা। তার কাছে বসে রইলুম।
আরও দুটো দিন কেটে গেল এই শ্মশানভূমিতে। ক্যারিববার কোনও জিনিস খুঁজে পাইনি। হয় ওরা কুড়িয়ে নিয়ে গেছে, নয়তো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ছাই হাতড়ে আমার চেহারা হয়েছিল ভূতের মতো। নোনা জলে ছাইগুলো ধুয়ে যাওয়া দূরের কথা, আরও চটচটে হয়ে এঁটে গিয়েছিল। পাথর ছুড়ে মাছ মেরেছি আর কাঁচা চিবিয়ে খেয়েছি। তৃতীয় দিনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলুম। একেবার চলচ্ছক্তিহীন অবস্থা। অতি কষ্টে সেই বেহালাবাদকের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়লুম, বুঝতে পারছিলুম, মৃত্যুর দেরি নেই। আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে পরম বন্ধুর মতো বেহালাবাদক গাছটি করুণ সুরে বেহালা বাজাচ্ছিল। তারপর আর বিশেষ কিছু মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, আমার চেতনার সঙ্গে ওই সুর একাকার হয়ে যখন গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিল, তখন কে যেন ডাকছিল, এনজেলো! এনজেলো! মাই সন! আমার সাড়া দিতে ইচ্ছে করছিল, এই তো আমি।…
চোখ মেলে কিছুক্ষণ বুঝতে পারলুম না কিছু। তারপর ভেসে উঠল পরিচিত একটা মুখ। সেই মুখে একরাশ সাদা দাড়ি আর স্নেহ। জয়ন্ত! ডার্লিং!
কর্নেল! আমি চমকে উঠে সাড়া দিলুম। আমি কোথায়? কর্নেল নীলাদ্রি সরকার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, রুবি আইল্যান্ডের মেরিন হসপিটালে। আশা করি, শিগগির শরীর সেরে যাবে। ভেবো না।
রোমিলাকে দেখতে পেলুম এতক্ষণে। সে একটু হেসে বলল, রিংপোর কাছে সব খবর পেয়ে কর্নেলকে জানিয়েছিলুম। আমরা ধরেই নিয়েছিলুম তোমাকে ওরা মেরে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে। যাই হোক, কর্নেল তক্ষুণি মিলিটারি হেলিকপ্টারে রওনা দিলেন। ওদিকে কিয়াংয়ের জাহাজকেও নেভির লোকেরা আটক করল। কিয়াং এখন জেলে।
কর্নেল বললে, কিওটার কালো রং দেখে আর চিনতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু বেহালার সুর শুনে যদি না ওদিকে এগিয়ে যেতাম, তোমাকে দেখতেই পেতুম না। যাই হোক, অন্তত একটা গাছ বেঁচে আছে ওখানে। ডঃ বিকর্ণ আর ক্যাপ্টেন ব্যুগেনভিলি ওখানে ক্যাম্প করে আছেন। ডঃ বিকর্ণের গবেষণার সুবিধে হবে।…