তোর পায়ে জুতো নেই দেখছি। ওহে রিংপো, ওকে তোমার জুতোজোড়া দাও বরং। আর তুমি বোটের কাছে গিয়ে পাহারা দাও।
প্রিয়বর্ধনের পায়ে জুতো দুটো ফিট করছিল না। বেঢপ রকমের প্রকাণ্ড জুতো পরে বেচারা থপ থপ করে এগিয়ে গেল ওদের সঙ্গে। রিংপো নামে লোকটা মুচকি হেসে বলল, এখানে একলা কান্নাকাটি করে কী হবে স্যাঙাত? এস—আমরা বরং বিচে গিয়ে গপ্পসপ্প করি।
বিচের ধারে একলা সেই বেহালা বাজিয়ে গাছটা করুণ চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখে বুঝলুম, শুধু এই ছোট গাছটাই বেঁচে আছে। পেছনদিকে পাথরের আড়ালে বিচের মাথায় আছে বলেই তার দিক চোখ পড়েনি কিয়াংয়ের। কিন্তু কেন সে বেহালা বাজাচ্ছে না? শোকে মূক হয়ে গেছে কি?
কাল রাতে তাহলে কিয়াংয়ের জাহাজ এসে পৌঁছনোর পর কিওটার উদ্ভিদ চেতনায় ওই উত্তেজনার সঞ্চার ঘটেছিল। পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় তাহলে আমি শোকসঙ্গীতই শুনেছিলুম।
রিংপো লোকটির মেজাজ ভাল। সে আমাকে ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢেলে দিয়ে বলল, নাও, খেয়ে ফেলো। দুঃখ করে কী হবে? গাছপালা বৈ তো নয়! তবে কি জানো। আমাদের কর্তাটি একেবারে শয়তানের অবতার। রোখ চাপলে আর ভালমন্দ জ্ঞানগম্যি থাকে না।
কফি খেতে ইচ্ছে করছিল না। তবু খেতে হল। ওর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করলুম। রিংপো রুবি দ্বীপেরই লোক। বউ ছেলেপুলে আছে। কিয়াংয়ের মাছের আর পুঁটকির মস্ত কারবার আছে। রিংপো অবশ্য মাছ ধরার কাজেই থাকে। তবে সে জানে, কর্তা বহুদিন আগে থেকে কিওটা দ্বীপের খোঁজ রাখে। রাজাকোর সঙ্গে একসময় তার খুব বন্ধু ছিল। রাজাকোও জানত সব। কিন্তু যতবারই ওরা কিওটা এসেছে, ভয়ঙ্কর কী বিপদ ঘটেছে। কোনওক্রমে প্রাণ নিয়ে ফিরে গেছে। তাই এবার সেজেগুজে মারাত্মক অস্ত্র সংগ্রহ করে এ-দ্বীপে পাড়ি জমিয়েছে।
কথায়-কথায় রিংপো বলল, এবার তোমার আর প্রিয়বর্ধনের ব্যপারটা বলো, শুনি। কীভাবে তোমরা এ-দ্বীপের খোঁজ পেয়েছিলে?
একে সংক্ষেপে সব কাহিনী শোনালুম। তারপর বললুম, রোমিলার খবর কিছু জানো? রিংপো বলল, জানি না। তবে শুনেছি, তুমি যাদের সঙ্গে রুবি দ্বীপে এসেছিলে, তারা তোমার মরা খুঁজে বেড়াচ্ছে সমুদ্রে।
বলে সে উঠে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখে নিল। তারপর চাপা গলায় ফের বলল, তোমার কথাবার্তা শুনে ভাল লোক বলে মনে হচ্ছে। তাই বলছি শোনো। বাইরের কেউ রোজারিওর গুপ্তধনের সাক্ষী থাক, সেটা সম্ভবত পছন্দ করবেন না কর্তামশাই। কাজেই তোমাকেও বাঁচিয়ে রাখবেন বলে মনে হয় না। অবশ্য প্রিয়বর্ধনের কথা আলাদা। সে রুবি দ্বীপেরই বাসিন্দা। তাকে দলে ভিড়িয়ে নিতেও পারেন। কিন্তু তোমার বাঁচোয়া নেই।
তার কথা শুনে শিউরে উঠে বললুম, তাহলে কী করতে বলছ আমাকে?
রিংপো একটু ভেবে বলল, জঙ্গলগুলো থাকলে লুকিয়ে থাকতে। কিন্তু কর্তামশাই তো সব ছাই করে ফেলেছেন। তুমি বরং এই সুযোগে সাঁতার কেটে দক্ষিণের প্রবাল পাঁচিলের কাছে চলে যাও। ওই পাঁচিলে অনেক গুহা আছে। লুকিয়ে থাকো গে। রুবি দ্বীপে ফিরে গিয়ে গোপনে আমি রোমিলাকে তোমার খবর দেব। সে তোমাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করবে।
দক্ষিণের প্রবল পাঁচিলে পৌঁছনো অসম্ভব রিংপো।
কেন? সাঁতার কাটতে পারো না?
পারি। কিন্তু স্বচক্ষে দেখেছি, ওদিকে বলয়সাগরের জলে ভয়ঙ্কর একটা জন্তু আছে।
তাহলে উত্তরের পাঁচিলে চলে যাও।
তার চেয়ে এ-দ্বীপের পশ্চিমে ওই পাহাড়গুলোর ভেতর গিয়ে লুকিয়ে পড়ছি বরং।
রিংপো লাফিয়ে উঠে বলল, কখনো না। কর্তার নজরে পড়ে যাবে। রোজারিওর কবরের তলায় যদি গুপ্তধন সত্যি সত্যি না থাকে, কর্তা সব জায়গা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে খুঁজবে। কী দরকার ঝুঁকি নিয়ে? আমার ধারণা, উত্তরের দিকটায় জল কম। আমি সারা জীবন জলে ঘুরছি। জল দেখে তার গভীরতা বলে দিতে পারি। তুমি কেটে পড়ো।
আমার জন্য তোমার ক্ষতি হবে না তো রিংপো?
রিংপো চটে গিয়ে বলল, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। সাধুগিরি ফলিও না তো বাপু। কর্তা কি আমাকে বলে গেছে তোমাকে পাহারা দিতে? সোজা বলে দেব, কেটে পড়েছে। কিংবা জঙ্গলদানবের পেটে গেছে।
একটু ইতস্তত করে বললুম, উপকার যদি করতে চাও, একটু বেশি করেই না হয় করলে ভাই রিংপো। তিনটে মোটরবোট এনেছ। একটায় চাপিয়ে আমাকে ওখানে পৌঁছে দিয়ে এস।
রিংপো পশ্চিম দিকটা ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, পারতুম। কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে কর্তা এসে পড়বে। তখন আমার প্রাণটাও যাবে।
অগত্যা জলে গিয়ে নামলুম। পুবের ভাঙন দিয়ে মহাসাগরের ঢেউ এসে ঢুকছে। তাই এদিকটায় ঢেউ আছে। কিন্তু উত্তরদিকটায় তত ঢেউ নেই। বাতাস বইছে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে। পোড়া দ্বীপের ছাই এসে পড়ছে জলে। কটু গন্ধ ঝাঁপটা মারছে নাকে। কোনাকুনি মাইলটাক সাঁতার কেটে কখনও ড়ুবো পাথরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলুম। প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল, এখনই জলদানব ভেঁস করে মাথা তুলে আমাকে তেড়ে আসবে। কিন্তু প্রবাল পাঁচিলে পৌঁছনো পর্যন্ত নিরাপদ রইলুম।
একটা চাতালে উঠে আবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলুম। তারপর অনেক কষ্টে পাঁচিলের মাথা পেরিয়ে ওপাশে গিয়ে আরেকটা চাতাল পাওয়া গেল। ঝাকে ঝুঁকে পাখি এখানে বসে আছে। উড়ে বেড়াচ্ছে। আমাকে দেখে ওরা গ্রাহ্য করল না। চাতালের একপাশে একটা ছোট্ট গুহাও পাওয়া গেল। এতক্ষণে ভাবনা হল, কবে ওদের জাহাজ ফিরে যাবে রুবি দ্বীপে, তারপর রিংপো খবর দেবে রোমিলাকে। ততদিন আমি বেঁচে থাকব তো? কী খেয়ে বাঁচব?