প্রিয়বর্ধন নিষ্পলক চোখে তাকিয়েছিল। এতক্ষণে ফিসফিস করে বলল, কিয়াং এসে গেছে! জয়ন্ত, একশোটা ক্যারিবো একটা কিয়াংয়ের সমান। তবে মাকড়সা-ক্যাকটাসের পাল্লায় পড়ে ওদেরও কী হয় দেখে নিও। আর একটা কথা। কিয়াংয়ের সঙ্গে আমরা ভাব জমাবো। ওরা যখন মারা পড়বে মাকড়সা-ক্যাকটাসের হাতে, তখন আমরা ওদের বোট নিয়ে ওদের জাহাজে চলে যাব।
কিয়াংয়ের চেহারা বেঁটে হলেও প্রকাণ্ড। সে নিচে লাফিয়ে পড়ে হা-হা করে হেসে বলল, আরে? রাজবংশের প্রাইভেট সেক্রেটারিমশাই যে! আর এই ছোকরা বুঝি সেই টেকো দাড়িয়ালা ঘুঘু বুড়োর শাগরেদ? কী? রোজারিওর গুপ্তধন হাতাতে পেরেছো তোমরা?
প্রিয়বর্ধন একগাল হেসে বলল, না স্যার! তবে গুহার ভেতর রোজারিওর কবর দেখতে পেয়েছি।
১৬. মহাশ্মশানের বেহালাবাদক
কিয়াং প্রিয়বর্ধনের কথা শুনে আরও হেসে বলল, রোজারিওর কবর আবিষ্কার করেছে, আর তার গুপ্তধন আবিষ্কার করতে পারোনি? আমি জানি, ওর কবরের তলায় সব ধনরত্ন পোঁতা আছে। চলো, সেই গুহাটা দেখিয়ে দাও।
প্রিয়বর্ধন আমাকে চোখের ইশারায় কী যেন বলে খুব উৎসাহ দেখিয়ে পা বাড়াল। কিন্তু ব্যাপারটা আমার ভাল মনে হল না। মাকড়সা ক্যাকটাসের হাতে খামোকা আবার এতগুলো লোকের মৃত্যু হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলুম না। তাই বললুম, মিঃ কিয়াং, শুনুন। ক্যারিববা আর তার দুই সঙ্গী এই দ্বীপে এসেছিল। তারা…
কথা কেড়ে কিয়াং বলল, সর্বনাশ! তাহলে তারাই সব হাতিয়ে কেটে পড়েছে।
বললুম, না। তারা এই দ্বীপের সাংঘাতিক মাকড়সা-ক্যাকটাসের পাল্লায় পড়ে মারা গেছে।
কিয়াং হাসল। জানি, জানি। সেবার ওদের পাল্লায় পড়ে আমার দলেরও পাঁচটা লোকের প্রাণ গেছে। তাই এবার আমি তৈরি হয়েই এসেছি।
মিঃ কিয়াং! ওদের গায়ে গুলি বেঁধে না!
কিয়াং তার কাঁধের ব্যাগ খুলে রিভলভারের মতো একটা জিনিস বের করে বলল, এটা কি জিনিস বুঝেছ? লেসার অস্ত্র। যে-কোনও সজীব পদার্থকে এক সেকেন্ডে ছাই করে ফেলবে। শুধু তাই নয়; পাথরের মতো নির্জীব পদার্থকেও গুঁড়ো করে দেবে। এর নল থেকে সাংঘাতিক লেসার রশ্মি বেরোয়। শুধু তাই নয়, ওই যে কামানের মতো জিনিসটা দেখতে পাচ্ছ, ওটা আরও শক্তিশালী লেসার বিম ছুড়ে মারে। কি, চলো প্রিয়বর্ধন! রুবি আইল্যান্ডের ঘুঘুগুলো হেলিকপ্টার নিয়ে সবসময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার জাহাজ দেখে তাদের সন্দেহ হতে পারে। ঝটপট কাজ সেরে ফিরে যাব। তার আগে অবশ্য ভূতুড়ে গাছপালাগুলোকে জ্বালিয়ে খতম করে দিয়ে যাব।
আমি দম আটকানো গলায় বলে উঠলুম, দোহাই মিঃ কিয়াং! কথা শুনুন—এই দ্বীপ বিজ্ঞানের এক ল্যাবরেটরি!
রাখো তোমার ল্যাবরেটরি! কিয়াং বিকট হাসল। আমি এবার এসেছি কিওটার ভূতগুলোকে খতম করতে। ওরা আমাকে খুব ভুগিয়েছে। আমার অনেক লোক মারা পড়েছে ওদের হাতে। আমি প্রতিশোধ নেবই।
বলে সে তার দলবল নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। প্রিয়বর্ধনকে ঠেলে নিয়ে চলল সে। কিন্তু আমার দিকে ঘুরেও তাকাল না।
একটু পরে শুরু হল কিয়াংয়ের পৈশাচিক কীর্তিকলাপ। যথারীতি স্টপ ইট! স্ট ইট চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতেই দেখলুম, তার এক সঙ্গী যেদিক থেকে চিৎকারটা আসছিল, সেইদিক লক্ষ্য করে লেসার কামান বসাল। তারপর দেখলুম, ডানদিকের জঙ্গল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। আমি দৌড়ে গিয়ে চেচিয়ে বললুম, স্টপ ইট! স্ট ইট! ওর এক অনুচর আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল।
কিয়াংয়ের মুখে পৈশাচিক হাসি। সে হুকুম দিল, এক চিলতে ঘাস পর্যন্ত আস্ত রাখবে না। ডাইনে-বাঁয়ে সব দিকের ওই ভূতুড়ে গাছপালাগুলোকে খতম করে দাও।
অসহায় চোখে দেখতে থাকলুম সে হত্যাকাণ্ড। লেসার কামানের মারাত্মক রশ্মিপুঞ্জ দেখতে। পাচ্ছি না—শুধু হিস হিস শব্দ হচ্ছে কামানটা থেকে আর ক্রমাগত আগুন ধরে যাচ্ছে গাছপালায়, ঝোপঝাড়ে। প্রকৃতির লক্ষ লক্ষ বছরের সাজানো সুন্দর উদ্যান জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছে। খোলা মাঠের সামনের দিকে সেই প্রাণী ক্যাকটাসের ঝক পাঁচিলের মতো এগিয়ে আসছিল। তারাও দাউদাউ জ্বলে কালো ছাই হয়ে ঘাসে মিশে গেল। ঘাসেও আগুন ধরে গেল। কালো চাপ-চাপ ধোঁয়ায় আকাশ কালো হয়ে গেল। বাতাসে কটু গন্ধ ছড়াল। সভ্যতার ভয়ঙ্কর মরণশক্তি চারপাশে তাজা সুন্দর সবুজ জীবনকে ধ্বংস করে চলল। লেসারকামান ঘুরে-ঘুরে হিস হিস শব্দে বিষের আগুন ওগরাচ্ছে। আর চোখের পলকে উজ্জ্বল আগুনের চোখ ধাঁধানো শিখা ছড়িয়ে পড়ছে।
আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। চোখের সামনে এই বিরাট ধ্বংসলীলা দেখেও আমার কিছু করার নেই। পাশে একটা ছিপছিপে তরুণ গাছ বুঝি দুঃখে কাতর হয়ে করুণ সুর বাজাতে শুরু করেছিল, নিষ্ঠুর কিয়াং তাকে লক্ষ্য করে লেসার পিস্তলের ট্রিগার টিপল। চোখের পলকে গাছটা কালো হয়ে খুঁড়িয়ে পড়ল এবং বাতাসে কয়েক মুঠো ছাই উড়ে যেতে দেখলুম। ধ্বংসের নেশায় কিয়াং মাতাল হয়ে উঠেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে যেদিকে তাকাই, সেদিকেই শুধু কালো ছাই। ছোট্ট দ্বীপের সব সবুজ, কালো ভস্মস্তুপে পরিণত। এক বিশাল শ্মশানভূমিতে একদল নিষ্ঠুর পিশাচের কাছে দাঁড়িয়ে আছি।
এতক্ষণে প্রিয়বর্ধন ধরা গলায় বলে উঠল, কাজটা কি ঠিক হল স্যার? কিয়াং তার মাথায় গাঁট্টা মেরে বলল, চল ব্যাটা ছুঁচো, কোথায় রোজারিওর কবর, দেখি।
প্রিয়বর্ধন কাঁদোকাঁদো মুখে বলল, ছাইগুলোতে পা পুড়ে যাচ্ছে স্যার!