ওমনি আমার মনে পড়ে গেল ব্রিটেনের লক নেস (Loch Ness) হ্রদের কিংবদন্তিখ্যাত জলচর প্রাণী নেসি (Nessie) এর কথা। এই রহস্যময় প্রাগৈতিহাসিক জলচর প্রাণীটির ছবি পর্যন্ত ক্যামেরায় তুলেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু বহু খোঁজ করেও তার পাত্তা পাওয়া যায়নি আজও। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ওই হ্রদের ভেতর কোনও গভীর সুড়ঙ্গে তার বসবাস।
এ কি তাহলে সেই নেসি?
বিকটাকার প্রাণীটির গলা এত লম্বা যে সে ইচ্ছে করলে অনায়াসে খাড়ির ওপর থেকে আমাদেরও টুপ করে মুখে তুলে নিতে পারে।
হয়তো সেই ভয়েই প্রিয়বর্ধন জঙ্গলের আড়ালে লুকোতে গেল। তারপর তাকে মাই গড বলে ছিটকে সরে আসতে দেখলুম। সরে এসে আবার চেঁচিয়ে উঠল সে। বললুম, কী হল প্রিয়বর্ধন?
প্রিয়বর্ধন একটা ঝোপের দিকে দেখিয়ে বলল, সাবধান জয়ন্ত, এই বিচ্ছু গাছগুলোকে চিনে রাখো। ব্যাটারা ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে সামুদ্রিক ঈল মাছের মতো। জোর বেঁচে গেছি।
ঝোপগুলোকে এড়িয়ে আমরা খোলা মাঠ ধরে ক্যাম্পে ফিরে গেলুম।…
সেদিন রাতে পূর্ণিমা। কিওটা বনভূমি যেন পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় মাতাল হয়ে উঠেছে। যেদিকে কান পাতি, সঙ্গীত শুনতে পাই। অপার্থিব যেন সেই সঙ্গীত। হু-হু করে হাওয়া দিচ্ছে আর মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে যেন পরীরা নেমে এসে নাচ-গানে জমিয়ে তুলেছে দ্বীপটাকে। প্রিয়বর্ধনের ওদিকে লক্ষ্য নেই। সে ক্যাম্পখাটে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। আমার পাহারা দেওয়ার পালা। কিন্তু কিসের জন্য এই সতর্ক পাহারা কে জানে? তবু মন মানে না বলেই ক্যারিববাদের ফেলে-যাওয়া একটা রাইফেল হাতে রেখেছি।
একসময় রাইফেলটা রেখে উঠে দাঁড়ালুম। পূর্ণিমারাতের বনভূমির মধুর অর্কেস্ট্রা প্রাণভরে উপভোগ করার জন্য কিছুটা এগিয়ে গেলুম।
তাহলে এমনি সব রাতেই প্রাচীন যুগে নাবিকরা কিওটা দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সঙ্গীত শুনতে পেত। সুদূর প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপে আদিম অদিবাসীরা এই দ্বীপের কথা শুনে হয়তো কোহাও রঙ্গো রঙ্গো পুঁথি রচনা করেছিল। কিন্তু এ-দ্বীপ এখনও সবাই খুঁজে পায় না—শুধু আমাদের মতো দৈবাৎ কেউ এখানে এসে পড়ে। তল্লাটের কোনও-কোনও দ্বীপে আদিম অধিবাসীরা অবশ্য এ-দ্বীপ কোথায়, তা ভালই জানে। তারা এখানে পুজো দিতে আসে। কিন্তু সভ্য মানুষের কাছে এর খোঁজ দিতে চায় না। আমরা সেদিন তাদের পাল্লায় পড়েছিলুম। আমার খোঁজে বেরিয়ে কর্নেল যদি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, তবেই এখান থেকে উদ্ধার হওয়ার আশা। নইলে বাকি জীবন এখানেই কাটাতে হবে।
আজ রাতে মনে হচ্ছিল, তা যদি হয়, তো হোক। কিওটার বৃক্ষরা আমার পরম বন্ধু হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যেই আমি আমৃত্য বরং থেকে যেতে রাজি।
জ্যোৎস্নায় খোলা মাঠ ঝলমল করছে। আবছাকালো দুধারের অরণ্যে অর্কেস্ট্রা বাজছে আর বাজছে। কত বিচিত্র সুর। গম্ভীর, সূক্ষ্ম। চড়া বা খাদে। ডাইনে এগিয়ে উঁচু উঁচু গাছগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে রইলুম। এলোমেলো হওয়া বইছে আর ডালপালা নড়ছে—ওই বুঝি তাদের নাচ। বৃক্ষমর্মরধ্বনির কথা কবিতায় পড়েছি। কিন্তু এতো তা নয়—এ এক আশ্চর্য মধুর ঐকতান। কে শেখাল এই সঙ্গীতের ভাষা। তা কানের ভেতর দিয়ে মর্মে গিয়ে আমাকে আবেগে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
কতক্ষণ তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম জানি না, একসময় প্রিয়বর্ধনের চিৎকারে আচ্ছন্নতা কেটে গেল। সে উত্তেজিতভাবে ডাকডাকি করছিল, জয়ন্ত! জয়ন্ত! তুমি কোথায়?
কোনও বিপদ ঘটেছে ভেবে দৌড়ে ক্যাম্পে ফিরে গেলুম। প্রিয়বর্ধন পুবের দিকে হাত তুলে বলল, একটা আলো দেখতে পাচ্ছ, জয়ন্ত? নিশ্চয় কোনও জাহাজ নোঙর করেছে। আলোটা একজায়গায় রয়েছে তখন থেকে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে তোমাকে ডাকলুম। সাড়া না পেয়ে বেরিয়ে আসতেই চোখে পড়ছিল আলোটা।
আলোটা এক জায়গায় আছে। তবে মাঝে মাঝে ঢেউয়ে আড়াল হচ্ছে, আবার ভেসে উঠছে। প্রবাল-পাঁচিলের ভাঙা অংশটা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বহুদূরের ওই আলো। আমরা তাকিয়ে রইলুম সেদিকে।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে অবাক হচ্ছিলুম। হাওয়াটা ক্রমশ বাড়ছে। অথচ আকাশ পরিষ্কার। এদিকে সারা দ্বীপ জুড়ে অর্কেস্ট্রার বাজনাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। কিওটার বনভূমি যেন উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। একসময় হওয়ার ঝাঁপটানি এমন প্রবল হল যে ক্যাম্পের দড়ি ছিঁড়ে খুঁটি উপড়ে কোথায় উড়ে গেল। আমরা বালির ওপর উপুড় হয়ে পড়লুম ঝড়ের ধাক্কায়। দুহাতে কানও ঢাকতে হল। প্রচণ্ড ঝড়ের শব্দ আর অর্কেস্ট্রার শব্দ মিলে কানে তালা ধরে যাচ্ছিল। বলয়সাগরের জল উপচে এসে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছিল। একসময় ওই প্রলয় আলোড়ন যখন ধীরে ধীরে কমে গেল, তখন চাঁদ পশ্চিমে ঢলে পড়েছে।
শেষ রাতে সব শান্ত হয়ে গেল। তখন ক্ষীণ সুরে শুধু বেহালার বাজনা কানে আসছিল। বড় করুণ সেই সুর। এ যেন শোকসঙ্গীত শুনতে পাচ্ছি। কার হৃদয়ের গভীর শোক কান্নার সুরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে। দূরে থমথম করছে আবছাকালো বনভূমি। মৃত্যুশোকের স্তব্ধতা রূপ নিয়েছে বুঝি।
তখনও জানতুম না, জানার উপায় ছিল না, একই শোকসঙ্গীত কেন। কেনই বা এত আলোড়ন।
একটু বেলা হলে দূরের সমুদ্র থেকে কুয়াশা কেটে গেল। তখন জাহাজটা দেখতে পেলুম। আমরা শুকনো পাতা ডালপালা জড়ো করে আগুন জ্বেলে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলুম। কিন্তু ততক্ষণে তিনটে মোটর বোট প্রবাল পাঁচিলের কাছে এসে পৌঁছে গেছে। তিনটে বোটেই একদল করে মানুষ। বোটগুলো যেভাবে ওরা ভাঙন পার করল, তাতে বুঝলুম ওরা এর আগেও দ্বীপে সম্ভবত এসেছে। ওরা তাহলে কারা?