প্রিয়বর্ধনকে কিওটা দ্বীপের গাছপালার রহস্য বোঝানোর চেষ্টা বৃথা। প্রাণের বিবর্তনের একটা স্তরে যখন উদ্ভিদ আর প্রাণী পৃথক হয়ে গিয়েছিল, সম্ভবত তখনই প্রকৃতির কী খেয়ালে এই দ্বীপে মাঝামাঝি একটা প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছিল, যারা প্রাণী এবং উদ্ভিদ দুই-ই! তাই তারা স্বাভাবিক উদ্ভিদের চেয়ে বেশিমাত্রায় চেতনাসম্পন্ন। তাদের বোধশক্তি প্রাণীদের মতোই, অথচ তাদের দেহ উদ্ভিদের মতো। আবার কোনও কোনও উদ্ভিদ প্রাণীদের মতোই চলাফেরা করতেও সমর্থ। যেমন ওই অদ্ভুত ক্যাকটাসগুলো—যারা ক্যারিবো, উংচু আর ফুতাংকে ধরে নিয়ে গেছে।
তিনদিন ধরে আমরা সারা দ্বীপ তন্নতন্ন খুঁজেও হতভাগ্য লোক তিনটিকে দেখতে পাইনি। কখনও মাকড়সা ক্যাকটাসগুলোকে একলা বা দলবেঁধে ঘুরতে দেখেছি। কিন্তু সাহস করে কাছে গেলেই তারা ঝটপট একগুচ্ছের শিকড় মাটিতে ঢুকিয়ে বকধার্মিক সেজে দাঁড়িয়ে থেকেছে—যেন কিছু জানে না। ক্যাকটাস না ক্যাকটাস। প্রিয়বর্ধন দাঁত মুখ খিচিয়ে বলেছে, ন্যাকা! কোথায় গুম করেছ বদমাশগুলোকে, বলো শিগগির! নইলে ঘ্যাচাং করে গোড়াটা কেটে ফেলব।
মাকড়সা-ক্যাকটাস নিশ্চয় বুঝতে পারে, প্রিয়বর্ধনের যত তড়পানি. শুধু মুখেই। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তবে আজ সকালে ভারি মজা হয়েছিল। যেই প্রিবর্ধন বকাবকি করতে গেছে, একটা মাকড়সা ক্যাকটাস আচমকা একটা শুড় বের করে ওকে জড়িয়ে ধরেছে। আর বেচারার সে কী ত্রাহি চিৎকার! শেষে আমি অনেক তোষামোেদ অনেক কাকুতিমিনতি করলুম। তখন খুঁড়টা খসে গিয়ে ছোট হতে হতে স্প্রিংয়ের মতো গুটিয়ে মাকড়সা-ক্যাকটাসটার ভেতর লুকিয়ে পড়ল। প্রিয়বর্ধন ল্যাজ তুলে দৌড়ে ক্যাম্পে চলে গেল। সেই থেকে আর নড়তেও চায় না। আবার মোটরবোটটা নিয়ে খুটখাট করে যাচ্ছে।
এদিকে ক্যারিবোদের আনা খাবারদাবার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমরা একবেলা গাছের ফলে বা বলয়সাগরের মাছ ধরে খিদে মেটাচ্ছি। অবশ্য খিদেয় মারা পড়ার আশঙ্কা নেই। দ্বীপে অসংখ্য ফলের গাছ আছে এবং অনেক গাছই দয়ালুদাতা।
আরেকটা কাজ দুজনে নিয়মিত করে যাচ্ছি। তা হল রেডিও ট্রান্সমিশন যন্ত্রের নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিভিন্ন ওয়েভলেন্থে মেসেজ পাঠানো। কোনও কোনও কেন্দ্রে মেসেজ গণ্ডগোল ঘটাচ্ছে। দু পক্ষের কথাবার্তা জড়িয়ে-মুড়িয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রটা বিকট ঘড়ঘড় শব্দ তুলছে। বিগড়ে যাওয়ার ভয়ে বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। কখনও দৈবাৎ কোনও কেন্দ্রে যদি আমাদের মেসেজ ধরা পড়ছে, কড়া ধমক অথবা ঠাট্টাতামাশা করা হচ্ছে। কিওটা নামে দ্বীপটা সরকারি মতে রূপকথা। এটাই হয়েছে সমস্যা। রুবি আইল্যান্ডে নৌবাহিনীর বেতারকেন্দ্র যদি দৈবাৎ ধরতে পারি, আমাদের আশা আছে তারা আমাদের মেসেজকে উড়িয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু কিছুতেই ওই কেন্দ্র ধরতে পারি না।
একদিন দুপুরে বহুদূরে একটা হেলিকপ্টারকে উড়তে দেখলুম। দুজনে আনন্দ নেচে উঠলুম। নিচে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলুম ওটার দিকে। কিন্তু নচ্ছার হেলিকপ্টারটা দূর দিয়েই চলে গেল। প্রিয়বর্ধন রেগে গাল দিতে শুরু করল। ওকে বুঝিয়ে বললুম, ভেবে দেখ প্রিবর্ধন, কোকোস দ্বীপপুঞ্জ এলাকায় হাজার-হাজার এমন দ্বীপ আছে। কোন দ্বীপটা যে কিওটা, সেটা খুঁজে বের করা আর খড়ের গাদায় সঁচ খোঁজা একই কথা। ধৈর্য ধরো। ওই হেলিকপ্টার আবার হয়তো আসবে এবং এই দ্বীপের ওপর দিয়েও উড়ে যাবে। তখন আমাদের দেখতে পাবে।
এরপর আমরা ঠিক করলুম, হেলিকপ্টারের শব্দ পেলেই আমরা শুকনো পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালাব। ধোঁয়ায় আকৃষ্ট হয়ে এদিকে ওদের চোখ পড়বেই।
কিন্তু আরও দুদিন কেটে গেল বৃথা। হেলিকপ্টারটা আর এমুখখা হল না।
তিনদিনের দিন দক্ষিণের বনভূমি পেরিয়ে খাড়ির মাথায় আমি একা দাঁড়িয়ে আছি, প্রিয়বর্ধন ক্যাম্পে আছে, সেই সময় নিচের একটা চাতালমতো জায়গায় চোখ পড়তেই চমকে উঠলুম। তিনটি সবুজ রঙের মানুষের মতো কারা পড়ে আছে। একেবারে উলঙ্গ তারা। ঝুঁকে ভালভাবে লক্ষ্য করে দেখি, হতভাগ্য ক্যারিবো, ফুতাং আর উংচু!
দ্রুত তাদের কাছে নেমে গেলুম। উপুড় হয়ে পড়ে আছে তারা। সারা গায়ে সবুজ দাগড়া-দাগড়া ছোপ। তাদের দেহে প্রাণ নেই। তিনটি লোভী মানুষের এই ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখে শিউরে উঠেছিলুম। সেই মারাত্মক ক্যাকটাস-প্রাণীর পাল্লায় পড়ে শ্বাসরোধ হয়ে সম্ভবত এরা মারা পড়েছে। কিন্তু ওই বিকটা সবুজ ক্ষতচিহ্নগুলি কি রুবিদ্বীপে শোনা সেই সবুজ এলার্জি রোগের চিহ্ন?
হতভাগ্য মানুষ তিনটির জন্য দুঃখ হচ্ছিল। ক্যাকটাস-প্রাণীরা তাদের এখানে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এরা মানুষ এদের মরা পড়ে থাকবে, এটা খারাপ লাগল। তক্ষুনি দৌড়ে গিয়ে প্রিয়বর্ধনকে ডেকে আনলুম।
প্রিয়বর্ধন সব দেখে বলল, কীভাবে এদের সদগতি করবে ভাবছ? এখান থেকে ওঠানো অসম্ভব। ক্যারিবো খ্রিস্টান, ফুতাং আর উংচু বৌদ্ধ। বরং এক কাজ করা যাক। এদের ঠেলে নিচের জলে ফেলে দিই। জয়ন্ত, সব শাস্ত্রেই বলেছে জল জিনিসটা শুদ্ধ৷ এদের আত্মার মুক্তি হবে। তাছাড়া নাবিকদের মৃত্যু হলে সমুদ্রের জলেই তাদের ফেলে দেওয়া চিরকাল সবদেশেরই রীতি।
দুজনে মৃতদেহ তিনটি ঠেলে নিচে খাড়ির জলে ফেলে দিলাম।
কিন্তু তারপর যা ঘটল তাতে আমরা আতঙ্কে হতবুদ্ধি হয়ে হাঁচড়-পাঁচড় করে ওপরে পালিয়ে আসতে বাধ্য হলুম। বলয়-সাগরের জল থেকে ভোঁস করে একটা লম্বাটে বিরাট মাথা বেরিয়ে এল। মুখটা কতকটা উটের মতো, কিন্তু সুচালো। লম্বা গলা। ছোট মাথা। কিন্তু শরীরটা তিমির মতো বিশাল। স্বচ্ছ জলে তার চারটে পাখনার মতো পা দেখা যাচ্ছিল। সেই বিকটাকৃতি সামুদ্রিক প্রাণীটি মহানন্দে মরা তিনটিকে পাখনা-পায়ে আটকে নিয়ে ভোঁস করে তলিয়ে গেল।