একটা লোকের মাথায় ফুলের মুকুট। তার হাতে একটা চওড়া কাস্তের মতো বাঁকানো চকচকে অস্ত্র। সে হুমহাম করে গর্জন করে অস্ত্রটা নাড়তেই প্রিয়বর্ধন চুপ করে গেল।
বালির ওপর অসংখ্য ফুল ছড়ানো আছে। সবুজ রং মাখা লোকগুলো বিকট নাচতে লাগল তার ওপর। ঢোল বাজছিল। সেটা দ্বিগুণ জোরে বাজতে লাগল। তারপর ওরা দুর্বোধ্য ভাষায় গান গাইতে শুরু করল।
মাথার ওপর সূর্য। বালি তেতে উঠছিল ক্রমশ। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল—লতা দিয়ে এমন শক্ত করে আমাদের বেঁধেছে যে রক্তস্রোত বন্ধ হয়ে গেছে যেন।
তাদের নাচগানবাজনা ক্রমশ চরমে পৌঁছল। মাঝেমাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলুম। এইভাবে কতক্ষণ কাটল জানি না, একসময় দেখি, ওরা আমাকে আর প্রিয়বর্ধনকে বয়ে নিয়ে চলেছে। ঠাহর করে বুঝলুম, সেই পাহাড়ি খাতের ভেতর দিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সেই গুহার প্রকাণ্ড মুখের সামনে ওরা আমাদের নামিয়ে দিল। তারপর দুজনকেই উপুড় করে শোওয়াল। বেশ বুঝলুম, এবার আমাদের মাথাটা কাটা হবে। আমরা কিওটা দ্বীপের বৃক্ষদেবতার বলি হব। ভাবলুম, প্রিয়বর্ধনকে মৃত্যুর মুহূর্তে শেষ বিদায় জানাই। কিন্তু কথা বেরুল না। তালু শুকিয়ে গেছে। কথা বলার শক্তিটুকুও আর নেই। তখন চিন্তা করলুম,
ওই কাস্তের মতো বাঁকা অস্ত্রটা দিয়ে নিশ্চয় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গলাটা কাটবে ওরা, যন্ত্রণাটা কতখানি হতে পারে।
এখন কিন্তু ঢাক বাজছে না। কেউ কথা বলছে না। আড়চোখে যতটা দেখা যায়, লোকগুলোর হাবভাবে চঞ্চলতা আঁচ করা যাচ্ছিল। একজন আমার এবং আরেকজন প্রিয়বর্ধনের পাশে বসে পড়ল।
হঠাৎ আমার মস্তিষ্কে বিদ্যুতের গতিতে একটা বোধ দেখা দিল। এ-দ্বীপের কৃষকবন্ধুদের এ বিপদে ডাকছি না কেন? সেই মুহূর্তে তখনকার মতোই আমার আচ্ছন্ন চেতনা থেকেই যেন সাড়া এল। অনেক কষ্টে ফিসফিস করে বলে উঠলুম, আমি এনজেলো দস সান্তোস! আমাকে বাঁচাও?
অমনি গুহার দিক থেকে ঝড়বাতাসের শব্দের মতো শব্দে উচ্চারিত হল : এনজেলো! এনজেলো! এনজেলো!
আমাদের পাশে বসে থাকা লোকদুটো তড়াক করে উঠে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। এনজেলো শব্দটা ক্রমশ বাড়ছিল। মনে হচ্ছিল ঝড় বইতে শুরু করেছে এনজেলো শব্দের।
তারপর শোনা গেল সেই প্রতিধ্বনি : স্টপ ইট! স্টপ ইট! আই সে স্টপ ইট! উঁচু পাহাড়ের দেওয়ালে সেই ভীষণ চিৎকার বিকট প্রতিধ্বনি তুলল। আই কিল ইউ। কিল…কিল…কিল! তারপর হেল্প! হেল্প! হেল্প!
দড়বড় দড়বড় শব্দ করে সবুজ রং মাখা পাতার পোশাক-পরা আদিম লোকগুলো ততক্ষণে উধাও। চেঁচামেচি থামলে মুখ অতিকষ্টে ঘুরিয়ে দেখি, জনপ্রাণীটি নেই। আর সামান্য তফাতে সেই কাস্তের মতো বাঁকা অস্ত্রটা পড়ে আছে। বুঝলুম, দেবতা বলি খেতে চায়নি বলে কিংবা ঘাতকের চোটে ব্যাটাচ্ছেলেরা অস্ত্রটা ফেলেই পালিয়ে গেছে। আমার গলায় এতক্ষণে জোর ফিরে এল। শরীরেও।
কিন্তু প্রিয়বর্ধনকে ডেকে সাড়া পেলুম না। গড়াতে গড়াতে অস্ত্রটার কাছে গেলাম। তারপর ওটার বাঁট কামড়ে চিত করে দুটো পাথরের মাঝখানে বসালুম। ঠোঁট কেটে গেল একটু। এবার কাত হয়ে অস্ত্রটার ডগায় হাতের বাঁধনটা ঘষতে থাকলুম। বাঁধন কেটে গেল। এবার আর অসুবিধে হল না।
একটু পরে প্রিয়বর্ধনের বাঁধন কেটে তাকে চিত করে দিলুম। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, আমি বেঁচে আছি, মরে গেছি?
বেঁচে আছে। ওঠো। প্রিয়বর্ধন তবু সন্দিগ্ধভাবে বলল, আমার ধড়টা কোথায়? যথাস্থানে আছে। উঠে পড়ো। আমার খিদে পেয়েছে।
ওকে টেনে ওঠালুম। ও কিছুক্ষণ হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে এবং লাফালাফি করে রক্ত চলাচল ঠিক করে নিল। তারপর একটু হেসে বলল, তুমি তো জয়ন্ত। কেন বলছিলে আই অ্যাম এনজেলো দস সান্তোস? এনজেলো শুনেছি কাপ্তেন রোজারিওর ছেলের নাম ছিল। ওর বউ ছিল পর্তুগিজ।
বললুম, ওসব পরে শুনব। এখন চলো, খিদে পেয়েছে।
১৫. কিয়াংয়ের আবির্ভাব
অচল মোটরবোটটা হয়ে উঠেছে আমাদের উদ্ধারের আশায় প্রতীক। অথচ বুঝতে পারছিলুম, প্রিয়বর্ধন যত পাকা মিস্তিরির ভান করুক, ওটা সচল করার মতো জ্ঞানবুদ্ধি ওর নেই। তবু সময়টা বেশ কেটে যায় আশায় আশায়। প্রিয়বর্ধন নানা ভঙ্গিতে চিত-উপুড়-কাত হয়ে কিংবা হাঁটু দুমড়ে গম্ভীরমুখে খুটখাট করে এবং কোনও এক জলদস্যু কাপ্তেন রোজারিও, তার পর্তুগিজ বউ আর ছেলে এনজেলোর গল্প শোনায়। রোজারিও নাকি তার বউ আর ছেলেকে নিয়ে এই দ্বীপে বাস করতে এসেছিল। সঙ্গে ছিল সারাজীবনের লুণ্ঠিত ধনরত্ন। কিন্তু ওর চেলারা কীভাবে খোঁজ পেয়ে সারারাত এখানে হানা দেয়। ওদের হত্যা করে। তারপর নিজেদের মধ্যে মারামারি করে নিজেরাও খুন হয়ে যায়।
এই কাহিনী শুনে আমার মনে হচ্ছিল, কিওটা দ্বীপের উদ্ভিদ রহস্যের কিছুটা যেন আঁচ করতে পেরেছি। খুব উত্তেজনার সময় মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে যে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়, দ্বীপের গাছপালার কোষে কোষে যেন তা সাড়া তুলতে সমর্থ। সেই উত্তেজনার সময়কার সব কথাবার্তা তাই রেকর্ড হয়ে যায় কোষগুলিতে। তারপর সম্ভবত আবহাওয়ার তাপমাত্রার হেরফের ঘটলে সেটাই হয়ে ওঠে রেকর্ডগুলি বেজে ওঠার কারণ। লক্ষ্য করেছি, স্টপ ইট চিৎকার নির্দিষ্ট সময় অন্তর বেজে ওঠে না। বেজে ওঠে হঠাৎই। কাজেই আবহাওয়ার হেরফেরের মধ্যেই রহস্যটা লুকিয়ে আছে।
মানুষের চিন্তাতরঙ্গের চাপ যে উদ্ভিদের ভেতরও সাড়া জাগায়, তা আধুনিক বিজ্ঞানীরা তো প্রমাণ করেছেনই। কর্নেলের কাছে মার্কিন বিজ্ঞানী ক্লি ব্যাকস্টারের গবেষণার কথা শুনেছিলুম। ব্যাকস্টার প্রথমে ছিলেন অপরাধ-বিজ্ঞানী এবং লাই-ডিটেকটর পরীক্ষক। 1966 সালে একটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে গাছের সাহায্যে হত্যাকারীকে ধরে ফেলেন। ব্যাকস্টার গ্যালভানোমিটার যন্ত্র সেই গাছের সঙ্গে যুক্ত করে সন্দেহযোগ্য লোকদের একে একে যন্ত্রটার সামনে দাঁড় করান। তারপর একটা লোক সামনে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকস্টার দেখলেন, গ্যালভানো মিটারের সংকেত কাঁটা প্রচণ্ডভাবে কাঁপতে শুরু করেছে। অর্থাৎ সেই গাছটা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সেই লোকটাকেই এই গাছটা খুন করতে দেখেছিল। পরে সে সব স্বীকার করে। তারপর জগতে সাড়া পড়ে যায়।