পরক্ষণে চমকে উঠলুম। এ আমি কী বলছি? আমার মুখ দিয়ে কার হয়তো পুরো নাম বেরিয়ে গেল—যাকে আমি চিনি না। জানি না। তার সঙ্গে আমার যুগের ব্যবধানও বিরাট। অথচ এনজেলো দস সান্তোস নামে সম্ভবত কোনও পর্তুগিজ নাবিকের নাম আমি উচ্চারণ করে ফেলেছি। কিন্তু এও বুঝতে পারছি যে এনজেলোকে ডেকে এখানে আনতে চাইছিল, সে ইংরেজ। কে সে?
এরপর আমার চেতনা যেন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একই শরীরে জয়ন্ত এবং এনজেলো কী করছে। ঠিক এভাবেই ব্যপারটা ব্যাখ্যা করা যায়।
হলফ করে বলতে পারি। ওই অন্ধকার গুহায় আমি কিছুতেই ঢুকতে পারতুম না। কিন্তু আমার আত্মায় এনজেলোর আত্মা ভর করেছে। আমি ঢুকে গেলুম ভেতরে। একটু পরে দৃষ্টি পরিষ্কার হল। ওদিকে কোনও ফাটল দিয়ে আলো আসছিল। প্রথমেই চোখে পড়ল দুটো গাছের ডাল আড়াআড়ি বেঁধে ক্রস গড়া হয়েছে এবং সেটা পোঁতা আছে গুহার মেঝেতে। নিশ্চয় একটা কবর। কবরের ওপর আবছা আলো এসে পড়েছে সরু ফাটল থেকে। তাই এক টুকরো তক্তা নজরে পড়ছিল। সেটা কবরে ক্রসের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো আছে। তাতে খোদাই করা আছে বড় বড় আঁকাবাঁকা হরফে :
ক্যাপ্টেন রোজারিও এনড্রস স্মিথ
মৃত্যু ১৬ জুন, ১৫৯১
ফলকটা তুলে ধরে পড়ছিলুম। সেই সময়, গুহায় যে দিক থেকে ঢুকেছি, তার উল্টোদিকে ফাটল থেকে আসা আলোয় একঝাক ব্যুমেরাং গড়নের সেই কাঠপোকাগুলোকে লাফিয়ে লাফিয়ে আসতে দেখলুম। আমার পায়ের কাছ দিয়ে ওরা লাফাতে লাফাতে গুহার দরজার দিকে চলে গেল। তারপর টের পেলুম ওদের পালিয়ে আসার কারণ। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলুম।
হনহন করে এগিয়ে আসছিল কেউ। ফাটলের আলোর কাছে সেও দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু ও কি মানুষ?
হ্যাঁ, মানুষই বটে। কারণ, আমার মতোই তার একটা মাথা, দুটো হাত, দুটো পা আছে। কিন্তু পরনে মাছের প্রকাণ্ড আঁশের মতো পাতার পোশাক যেন—পাতাবাহারের লাল-হলুদ চকরাবকরা রং ওই পাতাগুলোর। গলার কাছ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত এই বিচিত্র পোশাক। দুটো বাহু এবং পা খালি। সবচেয়ে অদ্ভুত ওর গায়ের রং। খসখসে সবুজ।
মুখটাও সবুজ। ভুরু ও চোখের পাতা খয়েরি রঙের। চোখের তারা লালচে, বাকি অংশ ছাই রঙের। তার মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো অবিকল উদ্ভিদের গুচ্ছ মূল যেন, —চুলের রং মেটে।
সেই অদ্ভুত মানুষটা নিষ্পলক তাকিয়ে আমাকে দেখছে।
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলুম। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে সম্ভাষণের ভঙ্গিতে একটু হাসলুম। তখন তার মুখেও হাসি ফুটে উঠল। সেও মাথাটা একটু দোলাল।
এবার আমি আমার জানা কয়েকটা ভাষায় তাকে জিগ্যেস করলুম, কে তুমি? কিন্তু মনে হল, আমার কথা সে বুঝতে পারছে না। অথবা সে বোবা।
তারপর সে আমাকে হাতের ইশারায় তার সঙ্গে যেতে বলে যেদিক থেকে এসেছে, সেইদিকে পা বাড়াল। মনে অস্বস্তি নিয়ে তাকে অনুসরণ করলুম। একটু এগিয়ে গুহার অন্য মুখে পৌঁছলুম। এ মুখটা বেশ বড়। দেখলুম, মুখের ওপর যে লতার ঝালর ছিল, তা দুপাশে সরিয়ে আটকে রাখা হয়েছে! হয়তো এই সবুজ মানুষটাই এ কাজ করেছে। বাইরে বেরিয়ে জায়গাটা চিনতে পারলুম। কাল আমি ও প্রিয়বর্ধন এই পাহাড়ি-খাতেই এসেছিলুম। অনেক নরকঙ্কাল পড়ে আছে এখানে-ওখানে। কিন্তু কালকের মতো কোনও চেঁচামেচি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল না। ভীষণ স্তব্ধ হয়ে আছে পরিবেশ। সবুজ মানুষ আমাকে ইশারা করল ডাইনে খুব সংকীর্ণ একটা খাতের ভেতর যেতে।
সেই খাতের ভেতর কিছুটা যাওয়ার পর এক অভাবিত দৃশ্য চোখে পড়ল।
আমাদের সামনে নিচে চওড়া অর্ধবৃত্তাকার একটা বেলাভূমি। সেখানে একদল এমনি রঙিন পাতার পোশাকপরা সবুজ মানুষ কী যেন করছে। তাদের হাতে গাছের ডাল। একটা প্রকাণ্ড পাতাশূন্য ডাল মাঝখানে পোঁতা আছে।
তারপরেই চোখে পড়ল জলের ধারে চার-পাঁচখানা ছিপ নৌকা।
সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথা পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝতে পারলুম, এই সবুজ মানুষরা আসলে আমার মতোই মানুষ। তারা গায়ে রং মেখে চোখ-ভুরু এঁকে এই দ্বীপে এসেছে কোনও উৎসব বা পুজোআচ্চা করতে। এরা কোনও দ্বীপের অধিবাসী তাতে সন্দেহ নেই। ওই নৌকায় চেপেই ওরা এসেছে।
এটা কিওটার উত্তর-পশ্চিম দিক। দূরে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে প্রবাল পাঁচিল। তাহলে এরা ঢুকল কোন্ পথে? পুবদিকের প্রবাল বলয়ের ভাঙা জায়গাটা ছাড়া এ-দ্বীপে আসার পথ তো নেই।
আমার প্রশ্নের জবাব তখনই মিলে গেল। ঢোলের শব্দ ভেসে এল এবং তারপর আতঙ্কে চেয়ে, দেখলুম, ডানদিকের পাহাড়ে সেই ঝরনার পাশ দিয়ে ধাপে ধাপে আরও একদল সবুজ রং মাখা মানুষ কাকে বেঁধে কাঁধে বয়ে আনছে। বিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলুম বেচারা প্রিয়বর্ধনকে।
আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া হল পালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু আমার সঙ্গী সেটা আঁচ করেই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটার গায়ে অসম্ভব শক্তি। কিন্তু উৎকট দুর্গন্ধেই কাবু হয়ে গেলুম। ওর গায়ের দুর্গন্ধটা নিশ্চয় রঙের কড়া ঝঝ। সে আমাকে মাটিতে পেড়ে দুর্বোধ্য ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল। অমনি নিচের বিচ থেকে কয়েকজন ছুটে এল। অসহায় হয়ে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিলুম।
প্রিয়বর্ধন চোখ বুজে পড়েছিল পোঁতা ডালটার সামনে। লতা দিয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ততক্ষণে বেঁধে ফেলেছে এরা। সে চোখ খুলে আমাকেও একই দশায় দেখে ভীষণ বিপদের মধ্যে করুণ হাসল। তারপর ফিসফিস করে বলল, অন্যদিকে ঘুরে বোট সারাচ্ছি, ব্যাটাচ্ছেলেরা কখন পেছন থেকে এসে…