যেই না মনে হওয়া, দৌড়ে গিয়ে মেন সুইচ অফ করে দিলাম। হাঁফাতে হাঁফাতে ফিরে এসে রুদ্ধশ্বাসে বললাম, কর্নেল! কর্নেল! আপনি সুস্থ তো?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার গর্জন করে উঠলেন, শাট আপ ইউ ফুল!
কস্মিনকালে ওঁর কাছে এমন ধমক খাইনি। আমি তো থ! একটু পরে অভিমান দেখিয়ে বললাম, বা! এই আপনার কৃতজ্ঞতাবোধের নমুনা! ইলেকট্রিক শক খেয়ে থিরথির করে কঁপছিলেন। এতক্ষণে অক্কা পেয়ে যেতেন। বাঁচিয়ে দেওয়াটা বুঝি অন্যায় হল? ঠিক আছে এবার খাবি খেতে দেখলেও মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব-তবে না আমার নাম জয়ন্ত!
কর্নেল তখন ফিক করে হেসে ফেললেন। উত্তেজিত হয়ো না ডার্লিং! তোমার কোনও দোষ নেই। ষষ্ঠীচরণ! ও ষষ্ঠি! ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ পর্দা তুলে মুখ বের করলে বললেন, মেন সুইচটা অন করে দাও। আর শোনো, ঝটপট আমার তরুণ বন্ধুর জন্যে কড়া করে কফি বানাও।আমিও খাব।
শান্ত হয়ে বসলে বললেন, জয়ন্ত! ওই মেক্সিকান ক্যাকটাসের সঙ্গে আমি একটু বাতচিত করছিলাম।
অবাক হয়ে বললাম, বলেন কী!
হ্যাঁ ডার্লিং! আচার্য জগদীশ বোসের যুগান্তকারী আবিষ্কারের পর অনেকগুলো দশক কেটে গেল। এখন বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, উদ্ভিদের শুধু সুখদুঃখের অনুভুতি নয়, সাড়া দেওয়ার শক্তি আছে। সেই সাড়া দেওয়াটাকেই বলব উদ্ভিদের ভাষা। ভাষাটা কিন্তু শব্দ দিয়ে নয়, কম্পন দিয়ে তৈরি। বিভিন্ন স্তরে সূক্ষ্ম-অতিসূক্ষ্ম কম্পনে তার কথা প্রকাশ পায়। এই ক্যাকটাসটা সবে কথা বলতে শুরু করেছিল এবং আমিও তার ভাষায় জবাব দিচ্ছিলাম—হঠাৎ তুমি এসে সবটাই ভেস্তে দিলে।
হাসতে হাসতে বললাম, আপনাকে হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কঁপতে দেখছিলাম। কী আশ্চর্য! ওভাবেই বুঝি গাছপালার সঙ্গে কথা বলতে হয়?
কর্নেল জারে ভাসমান ক্ষুদে যন্ত্রটা দেখিয়ে বললেন এটা একটা গ্যালভানোমিটার। তুমি লাই-ডিটেক্টর যন্ত্রের কথা জানো—যা অপরাধী সত্য বলছে, না মিথ্যে বলছে, ধরিয়ে দিতে পারে। এটা তারই একটা অংশ। এর ভেতর একটুকরো গ্র্যাফ-পেপার আছে এবং একটা সূক্ষ্ম পেন্সিলের শিস আছে। গত শতকের শেষভাগে ভিয়েনার এক ধমর্যাজক ফাদার ম্যাক্সিলিয়ান হেল এর উদ্ভাবক। পরে ইতালীয় বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানি প্রাণীজ বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে যন্ত্রটা আরও উন্নত করেন। তাঁর নামে যন্ত্রটার নাম দেওয়া হয় গ্যালভানোমিটার। আরও পরে ইংরেজ বিজ্ঞানী স্যার চার্লস হুইটস্টোনের আবিষ্কৃত বিদ্যুৎ সার্কিট হুইটস্টোন ব্রিজ পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়েছে। তবে…?
বাধা দিয়ে বললাম, কিচ্ছু বুঝব না। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম না।
তা হলে গাছের পাতা নিয়ে ব্যাকস্টার নামে এক বিজ্ঞানীর পরীক্ষার কথা শোনো! তিনি অসংখ্য পরীক্ষার পর বলেছিলেন, উদ্ভিদেরা চক্ষু ছাড়াই দেখতে পায়—মানুষ যতটা দেখতে পায়, তারও বেশি। উদ্ভিদের যেন মন আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, সে এই বিশাল প্রাণীজগতের অন্যতম শরিক এবং সে সব প্রাণীর মনের কথা টের পায়।
সেই ব্যাকস্টার সায়েব বলেছেন এ কথা? আমি হাঁদারামের মতো তাকিয়ে বললাম। সর্বনাশ! যখন আপনার বাসায় আসি, ওইসব বিদঘুটে গড়নের উদ্ভিদগুলোকে দেখে মনে মনে কত হাসি এমনকী, একদিন আপনার পরীক্ষিত ওই অষ্টাবক্র ক্ষুদে উদ্ভিদটিকে দেখিয়ে যেদিন ষষ্ঠীচরণকে বলছিলাম, ব্যাটা যেন সার্কাসের ক্লাউন! ওরে বাবা! তা হলে তো ও বেজায় রাগ করছিল আমায় ওপর!
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, এই যে এখন তুমি এসেছ এবং তার কথাবার্তায় বাধা দিয়েছ, এতে ও কি ক্রুদ্ধ না হয়ে পারে?
কাছে গেলে প্যাঁক করে কাটা ফুটিয়ে দেবে বুঝি?
তা হয়তো দেবে না। কিন্তু তুমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রোড থেকে বিকিরণ বেড়ে গিয়েছিল এবং গ্যালভানোমিটার কাপছিল। একমিনিট। গ্রাফটা বের করি।
কর্নেল ক্ষুদে যন্ত্র থেকে একটুকরো কাজ বের করে দেখালেন। অসংখ্য আঁকাবাঁকা রেখা জটিল হয়ে আছে দেখলাম। বললাম, এই বুঝি ওর রাগের ভাষা?
কর্নেল আমার তামাশায় কান না দিয়ে বললেন, এই কাগজটার নাম পলিগ্রাফ। বিখ্যাত ব্যাকিস্টার এক্সপেরিমেন্টের সূত্র ধরে আমি এই জটিল রেখাগুলোকে বিশ্লেষণ করতে পারি। এগুলো কোড ল্যাঙ্গেয়েজ অর্থাৎ সাংকেতিক ভাষা। কোডগুলোকে শ্ৰেণীবদ্ধ করে অর্থোদ্ধার করা সম্ভব। যাই হোক, আপাতত কফি খাও। তারপর দুই বিজ্ঞানী স্যাক্স রোমার এবং বুলওয়ার লিটনের পরীক্ষার গল্প বলব। সে আরও বিচিত্র ঘটনা। তারা আমেরিকার নিউ জার্সিতে একটা কারখানার কাছে খুন হওয়া একটি মেয়ের খুনিকে ধরিয়ে দিতে পেরেছিলেন!
আপনার মতো তারা শখের গোয়েন্দাও ছিলেন বুঝি?
না, জয়ন্ত। ওঁরা নিছক বিজ্ঞানী। পদার্থ এবং জীববিদ্যার চর্চা করতেন। যেখানে মেয়েটি খুন হয়েছিল সেখানে ছিল একটা বুনো আপেল গাছ। গাছটাই ধরিয়ে দিয়েছিল খুনিকে।
চেঁচিয়ে বলেছিল পাকড়ো! পাকড়ো!
তামাশা নয়, ডার্লিং! এটা বাস্তব ঘটনা। একটুকরো পলিগ্রাফ আর একটা গ্যালভানোমিটার, একটা ইলেকট্রোড—ব্যস! এ তিনটি জিনিস গাছটার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে লোক জড়ো করা হয়েছিল গাছটার সামনে। একবার করে পাতা ছুঁয়ে যেতে বলা হয়েছিল প্রত্যেককে। তারপর দেখা গেল, একজনের ছোঁয়ার পর পলিগ্রাফে গাছটা তীব্রভাবে সাড়া দিয়েছে। কম্পনরেখা বিশ্লেষণ করে বোঝা গেল, সেই লোকটাই খুনি।