এই বলে সে ফ্যাচ করে নাক ঝেড়ে কেঁদে ফেলল। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, ভেবো না প্রিয়বর্ধন। আমার উদ্ধার হলে তোমারও হবে। তাছাড়া মোটরবোটটা তো আছেই। বরং এবারে ট্রান্সমিশন চালু করে আমরা খবর পাঠাই বিভিন্ন ওয়েভলেন্থে। কোনও-না-কোনও কেন্দ্রে তা ধরা পড়বেই।
এদিন দুপুর পর্যন্ত ওই নিয়ে ব্যস্ত থাকলুম দুজনে। কখনও আমি ইংরেজিতে, কখনও প্রিয়বর্ধন বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন ওয়েভলেন্থে জানাতে থাকলুম, আমরা জয়ন্ত চৌধুরি আর পিওবেদেনে এই দুজন লোক কিওটা দ্বীপে আছি। অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ জানা নেই। তবে ডাইনির দ্বীপ থেকে আন্দাজ সাতশো নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে এটা একটা বলয়দ্বীপ। আমাদের উদ্ধার করো।
কোনও জবাব পাচ্ছিলাম না। মাত্র একবার সম্ভবত কোনও এমেচার বা শৌখিন বেতার ট্রান্সমিশন যন্ত্রের মালিক বলে উঠল, কিওটা? ফকুরি করা হচ্ছে? শোনো, ওই রসিকতা আমিও করে ভীষণ বিপদে পড়েছিলুম। নৌবাহিনীর গোয়েন্দারা এসে আমাকে ধরে বেদম ঠেঙিয়েছিল। সাবধান!
তাকে ব্যাকুলভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেও কাজ হল না। সরকারি কেন্দ্রের ওয়েভলেন্থে আমরা ধরতে পারছিলুম না। কিন্তু ধরতে পারলে তারাও হয়তো মস্করা ভেবে উড়িয়ে দেবে। শেষে হতাশ হয়ে বললুম, যাক গে। চলো প্রিয়বর্ধন, ক্যারিবো বেচারাদের খোঁজে বেরোই। হাজার হোক, ওরা মানুষ তো!
১৪. এনজেলো! এনজেলো!
প্রিয়বর্ধন আমার সঙ্গে এল না। বলল, শয়তান ক্যারিবো আর ওই দুই ওরাংওটাংকে উদ্ধারের একটুও ইচ্ছা আমার নেই জয়ন্ত! ওরা উচিত শাস্তি পেয়েছে। বরং ততক্ষণ আমি মোটরবোটটা মেরামত করতে থাকি।
আমার মন বলছিল, এ দ্বীপে আমি নিরাপদ। এই বিচিত্র সুন্দর বনভূমি আমার অসংখ্য বন্ধুতে ভরা। তারা মানুষের মতো করে কথা না বলতে পারলেও নিজেদের মতো করে কথা বলে। আমার চেতনায় অনুরণিত হচ্ছে তাদের মনের কথা। প্রতি মুহূর্তে টের পাচ্ছি, ওরা বলতে চাইছে, তুমি আমাদের বন্ধু, তুমি আমাদের প্রিয় অতিথি।
এক বিশাল গাছের সামনে দাঁড়িয়ে তার পায়ে হাত রাখলুম। আবার চমকে উঠলুম। যেন কোনও প্রাণীর শরীর। মনে মনে বললুম, আমি কোনও ক্ষতি করতে আসিনি তোমাদের। আমার মনে রোজারিওর গুপ্তধনের বিন্দুমাত্র লোভ নেই।
আশ্চর্য, আমার চেতনায় কী একটা বোধ সঞ্চারিত হল তখনই। যেন এই বৃদ্ধ প্রপিতামহ বৃক্ষের সস্নেহ কিছু আশীর্বাদ বাক্য অস্পষ্টভাবে অনুভব করলুম। তারপর গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চললুম বনের ভেতর দিয়ে। আমার সাহস চতুগুণ বেড়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে কেউ সামনের দিক থেকে হঠাৎ খুব চাপা গলায় ফিসফিস করে বলে উঠল, এনজেলো! এনজেলো অমনি থমকে দাঁড়ালুম। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলুম না।
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, কাপ্তেন জর্জ ব্যুগেনভিলিও ঠিক এই ডাক শুনেছিলেন কিওটা দ্বীপে। তাহলে এও প্রাচীন যুগের সম্ভবত কোনও নাবিকেরই কণ্ঠস্বরের ভূতুড়ে প্রতিধ্বনি। একটু হাসিও পেল। এক রাজার কান দুটো দেবতার অভিশাপে গাধার কানে পরিণত হয়েছিল। নাপিত ব্যাপারটা টের পেয়েছিল। কিন্তু কাউকে বললেই তো গর্দান যাবে। শেষে মাঠের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে ফিসফিস করে বলেছিল, রাজার কান দুটো গাধার! কিছুকাল পরে সেখানে গজালো একটা নলখাগড়ার ঝোপ। আর বাতাস বইলেই সেই ঝোপ থেকে ফিসফিস করে উচ্চারিত হত, রাজার কান দুটো গাধার! প্রাচীন এশিয়া মাইনরের হিটাইট দেশের মিতান্নি গোষ্ঠীর রাজা মিদাসের গল্প এটা। কিং মিদাস হ্যাজ অ্যাসেস ইয়ারস! নলখাগড়ার ঝোপটা ফিসফিস করে বাতাসের সুরে ঘোষণা করত।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, উদ্ভিদের এই বেয়াড়া স্বভাবের কথা যেন প্রাচীন যুগের মানুষরাও অন্তত আঁচ করতে পেরেছিল।
কিন্তু আরও কিছুটা এগিয়ে আবার সামনে থেকে কেউ ফিসফিসিয়ে উঠল, এনজেলো! এনজেলো। কাম অন! কাম অন!
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কে তুমি ডাকছ এনজেলো বলে? আমি এনজেলো নই।
এনজেলো! ফলো মি।
কেউ এনজেলোকে বলছে, আমাকে অনুসরণ করো। আমি অবাক হয়ে হাঁটতে থাকলুম। কথাগুলো ক্রমশ আমার আগে-আগে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কিছুক্ষণ অন্তর-অন্তর। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলেছি। একটু পরে টিলা পাহাড়ের কাছে পৌঁছলুম। সামনে একটা ফাটল। ফাটলের দুধারে কেয়াগাছের মতো দেখতে একরকম গাছ সারবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল, ওই গাছগুলোর ভেতর থেকে এনজেলো বলে ডাক ভেসে আসছে। এবার গা ছমছম করতে থাকল। এ যেন শেষ পর্যন্ত ভৌতিক ঘটনা হয়ে যাচ্ছে। কোনও অশরীরী মানুষ যেন আমাকে এনজেলো ভেবে কোথায় ডেকে নিয়ে চলেছে।
আবার ইংরেজিতে সেই অশরীরী ফিসফিসিয়ে বলে উঠল : এনজেলো, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। চলে এসো!
পেছন ফিরে বনভূমির দিকে তাকালুম। মনে বললুম, খাব কী? আগের মতোই আমার চেতনার ভেতর সূক্ষ্ম তরঙ্গের মতো এক বোধ সঞ্চারিত হল। ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না,
শুধু বুঝলুম, আমাকে যেতে হবে! তখন হনহন করে সেই ফাটলের ভেতর দিয়ে চলতে শুরু করলুম।
আন্দাজ কুড়ি-পঁচিশ মিটার পরে দেখি একটা গুহার মুখ। মুখের ওপর ঘন লাতাপাতার ঝালর পর্দার মতো ঝুলছে। অসংখ্য ফুল ফুটে রয়েছে নানা রঙের। সুগন্ধে মউ মউ করছে। এ জায়গাটা বেশ চওড়া। একটা ঝাকড়া গাছ যেন সূকুটি-কুটিল অজস্র চোখ দিয়ে আমাকে দেখছে। সাবধানে এগিয়ে ঝালরগুলো দুহাতে সারালুম। গুহার ভেতর ঘন অন্ধকার থমথম করছে। ভূতগ্রস্তের মতো আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমি এসেছি—আমি এনজেলো দস সান্তোস!