প্রবাল বলয়ের দিকটা জ্যোৎস্নায় কালো পাঁচিলের মতো দেখাচ্ছিল। দূর থেকে আছড়ে পড়া জলের চাপা গর্জন কানে আসছিল। আমাদের পেছনে কোথায় সেই বেহালা বাজিয়ে গাছটা ঘুমঘুম সুরে বেহালা বাজাচ্ছিল। ক্যারিববা আমাদের দুজনকে ফুতাং ও উংচুর কড়া পাহারায় রেখে ছোট্ট তাঁবুর ভেতর ক্যাম্পখাটে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল। আমার চোখে ঘুম নেই। প্রিয়বর্ধনেরও নেই। দুজনে পাশাপাশি চিত হয়ে তাঁবুটার সামনে বালির ওপর শুয়েছিলুম। আমাদের দুপাশে দুই প্রহরী বসে সেই বিচ্ছিরি কড়া সিগারেট টানছিল আর চাপা গলায় নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলছিল।
এমন সময় কী একটা শব্দ হল। খসখস শব্দ। মুখটা সাবধানে ঘুরিয়ে দেখি, ক্যারিববার তাঁবুর পাশে কালো ঝোপ মতো—কোনও জন্তু নয় তো? কিওটায় এ পর্যন্ত ময়াল সাপ ছাড়া কোনও জন্তু দেখিনি। নাকি সত্যি একটা ঝোপ?
কিন্তু কাছাকাছি কোথাও ঝোপও তো দেখিনি। জায়গাটা অনেকটা খোলামেলা। তাহলে ওটা কী হতে পারে! নিশ্চয় কোনও জন্তু। প্রহরীরা আপন কথায় ড়ুবে আছে। একটু পরে দেখলুম, কালো জিনিসটা নড়ে উঠল এবং এগিয়ে আসতে থাকল। জ্যোৎস্না এতক্ষণে পরিষ্কার হয়েছে। এবার স্পষ্ট দেখতে পেলুম, দিনে যে ক্যাকটাসকে হেঁটে বেড়াতে দেখেছি, এটা সেই চলমান উদ্ভিদই বটে। খসখস শব্দে প্রহরীদের চমক জাগল। তারা যেই ঘুরেছে, অমনি সেই ক্যাকটাস-জন্তু (!) অক্টোপাসের অথবা মাকড়সার মতো একগুচ্ছের শুড় বাড়িয়ে উঁচু ও ফুতাংকে জড়িয়ে ধরল। দুজনেই বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠল। ক্যারিবোর ঘুম ভেঙে গেল। সে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল। তার হাতে টর্চ ছিল। টর্চের আলোয় দেখল, অদ্ভুত ক্যাকটাস-মাকড়সা উংচু ও ফুংকে নিয়ে খসখস আওয়াজ করতে করতে এগিয়ে চলেছে। ক্যারিবো বিস্ময়ে আতঙ্কে এমন হকচকিয়ে গেল যে টর্চ জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই।
আমি ও প্রিয়বর্ধন উঠে বসেছিলুম। প্রিয়বর্ধন কী বলে চেঁচিয়ে উঠল। নিশ্চয় গুলি ছুড়তে বলল ক্যারিবোকে। কারণ তারপরই ক্যারিববা রিভলভার উঁচিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে তাড়া করল।
কিন্তু আশ্চর্য, ক্যাকটাস-মাকড়সার গায়ে যেন গুলি বিধছে না। ক্যারিববার টর্চটা উত্তেজনার ফলে হাত থেকে পড়ে গিয়ে নিবে গেছে। প্রিয়বর্ধন দৌড়ে গিয়ে টর্চটা তুলে নিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে কোথা থেকে আরও কয়েকটা ক্যাকটাস-মাকড়সা খসখস শব্দ করতে করতে ক্যারিববাকে ঘিরে ফেলল। তারপর আর ক্যারিববাকে দেখতে পেলুম না। বিচিত্র উদ্ভিদ-প্রাণীর দল ব্যুহের ভেতর ঘিরে ওকে নিয়ে চলেছে। সেই দৃশ্য দেখে প্রিয়বর্ধনের হাতে টর্চ নিভে গেল এবং সে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, জয়ন্ত! জয়ন্ত! ডাইনিরা ওদের ধরে নিয়ে গেল।
বললুম, তাহলে এবার আশা করি, তুমি বুঝতে পেরেছ, গুপ্তধনের ললাভের শাস্তি পেল ওরা।
প্রিয়বর্ধন দিব্যি কেটে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ জয়ন্ত! আমার আর গুপ্তধনের লোভ করা উচিত নয়।
তাঁবুর কাছে ফিরে এসে বললুম, যাক গে। কিওটা থেকে ফেরার আর চিন্তা রইল না। মোটরবোটটা যদি তুমি মেরামত করতে পারো, আমরা সমুদ্র পাড়ি দেব।
তাঁবুর সামনে স্টোভ জ্বেলে আমরা আবার কফি তৈরি করলুম। কফি খেতে খেতে জ্যোৎস্নাভরা বনভূমির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, একটু আগের সেই বিভীষিকার কোনও আভাস নেই। বেহালা বাজিয়ে গাছটা একলা দাঁড়িয়ে কোথায় আপন মনে বেহালা বাজাচ্ছে। চারদিকে ঘুমঘুম আচ্ছন্নতা। কফি খেয়ে প্রিয়বর্ধন ভয়মাখানো গলায় বলল, জয়ন্ত, আমরা বরং পালা করে পাহারা দিই। যদি ওই ভূতুড়ে ক্যাকটাসগুলো আমাদেরও বন্দি করে নিয়ে যায়?
ওকে অশ্বাস দিয়ে বললুম, প্রিয়বর্ধন, কিওটার উদ্ভিদেরা মানুষের মনের কথা যেন টের পায়। আমাদের মস্তিষ্কের চিন্তাতরঙ্গ হয়তো ওদের স্নায়ুতে প্রতিধ্বনি তোলে। আমরা যদি এ-দ্বীপে কোনও খারাপ মতলব না আঁটি, ওরা আমাদের ক্ষতি করবে না। এস, আমরা আরাম করে ঘুমোই।…
এরাতে কোনও বিপদ ঘটল না। কখন একবার কিছুক্ষণের জন্য ঘুম ভেঙে কানে এসেছিল, কারা যেন দূরে মধুর সুরে গান গাইছে। এমন অপার্থিব সঙ্গীত পৃথিবীর মানুষের কণ্ঠে শোনা অসম্ভব। জ্যোৎস্নারাতে কিওটার বনভূমিতে বিশ্বপ্রকৃতি নিজের হৃদয় খুলে দিয়েছে যেন।
শেষ রাতে একবার যেন শুনলুম, কে কোথায় খিলখিল করে হেসে উঠল—যেন মেয়েদেরই হাসি। স্বপ্নও হতে পারে। বাস্তবও হতে পারে। পুরুষ উদ্ভিদের মতো মেয়ে উদ্ভিদও তো আছে।
সকালে ক্যারিবোরা প্রচুর খাদ্যদ্রব্য, দড়িদড়া, শাবল, হাতুড়ি, এমনকী একটা বেতার ট্রান্সমিশন সেট পর্যন্ত নিয়ে এসেছে দেখে খুব আনন্দ হচ্ছিল। প্রিয়বর্ধন যতক্ষণ ব্রেকফাস্ট তৈরি করছিল, ততক্ষণ আমি ওই বেতার যন্ত্রটাকে চালু করার চেষ্টা করছিলুম। চালু হতেই রিসিভিং কেন্দ্রে অস্পষ্টভাবে দুর্বোধ্য ভাষায় কোন কেন্দ্রের ব্রডকাস্টিং ভেসে এল। প্রিয়বর্ধন নেচে উঠল তার মাতৃভাষা শুনে। বলল, সিঙ্গাপুর কেন্দ্রে খবর হচ্ছে। নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটা করে কেন্দ্রের সাড়া পায় আর সে চেঁচিয়ে ওঠে উত্তেজনায়। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা দক্ষিণ এশিয়ার বহু ভাষা সে জানে। কিছুক্ষণ পরে সে কোন্ কেন্দ্র থেকে কান করে কিছু শোনার পর দম আটকানো গলায় বলে উঠল, জয়ন্ত জয়ন্ত! তোমার খবর হচ্ছে। রুবি আইল্যান্ডের নৌবাহিনীর ব্রডকাস্টিং সেন্টার থেকে জাহাজগুলোকে জানিয়ে দিচ্ছে তোমার নিরুদ্দেশের খবর। কিন্তু আমার কথা তো কেউ বলছে না!